যখন আমরা দুধের কথা চিন্তা করি তখন গরু, ওট বা বাদামের দুধ আমাদের চোখে ভেসে আসে। এই ধরনের দুধের সাথে পশ্চিমারা সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
বিশ্ব বিখ্যাত ম্যাকডোনাল্ড, স্টারবাকস বা স্থানীয় শপ গুলোতে এসব দুধের বিকল্প পাওয়া যায়। তবে পশ্চিমারা কখনও এই দুধের বিকল্প হিসাবে শপিং লিস্টে ছাগলের দুধ আশা করে না।
কিন্তু যেভাবে ছাগলের দুধের চাহিদা বাড়ছে তাতে একদিন হয়তো ছাগলের দুধের নামও তাদের শপিং লিস্টে যুক্ত হতে পারে। এবং তা আর বেশি দূরে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং রিসোর্স সেন্টার বলছে, ছাগলের দুগ্ধজাত পণ্য ব্যবহারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোতে। তবে এটি বর্তমান বাজারে বিদ্যমান দুধগুলোর সমান বা বিকল্প হয়ে উঠেনি।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম দুধ উৎপাদনকারী দেশ ভারত এবং দেশটি ছাগলের দুধের শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তালিকায় ভারত, বাংলাদেশ ও সুদান এ তিন দেশ ছাগলের কাঁচা দুধ উৎপাদনে শীর্ষে।
ছাগল এই দেশগুলোতে একটি সাধারণ প্রাণী, বিশেষ করে ভারতের গ্রামীণ এলাকায় ছাগল পালন অপরিহার্য দেখা যায়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠির মধ্যেও ছাগল পালনের প্রবণতা দেখা যায়। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই দরিদ্র পরিবারগুলোতে ছাগল পালন করে থাকে।
মার্কিন গবেষণা সংস্থা সায়েন্স অ্যালার্ট অনুসারে, ভারতের কৃষকরা কমপক্ষে বিশটি ছাগলের জাত লালন-পালন করে থাকেন।
তবে যমুনাপারি, বারবারি, বিতাল, সুরতি ও জাখরানা জাতের ছাগল তাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। এ জাতের ছাগল ভালো মানের দুধ দেয়।
মার্কিন বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা দ্য সায়েন্স এগ্রিকালচার এর এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০২১ সালে ভারতে ৫৪ লাখ টন ছাগলের দুধ উৎপাদন হয়েছে।
তারপরে বাংলাদেশ ২৭ লাখ ৫০ হাজার টন ছাগলের দুধ উৎপাদন করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬৫ ভাগ দুগ্ধজাত খাবার আসে ছাগল থেকে।
আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর গোট রিসার্চের তথ্য বলছে, ছাগলের দুগ্ধজাত খাবার বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনপ্রিয়। অন্য গবাদি পশুর তুলনায় ছাগলের যত্ন নেওয়া ও রক্ষণাবেক্ষণ সহজ।
তবে ছাগলের দুধ দরিদ্র সম্প্রদায়কে অপুষ্টি থেকে সুরক্ষা করে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে। এর স্বাস্থ্য গুনাগুণ ও সাশ্রয়ী মূল্যের কারণেও ছাগলের দুধের চাহিদা ভারতে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
ছাগলের দুধের ইতিহাস:
উপমহাদেশে ছাগল ও এর দুধ বর্তমানে খুবই পরিচিত। তবে ছাগলের ইতিহাস দীর্ঘকালিন। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে ছাগল মানুষকে পুষ্টি দিয়ে যাচ্ছে।
এর ইতিহাস কত দীর্ঘকাল এমন প্রশ্ন আসতে পারে। তবে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে আমেরিকার ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন।
সংস্থাটি বলছে, ক্যাপ্রা হিরকাস নামে এক ধরনের প্রাণী প্রায় ১০ হাজার বছর আগে নিওলিথিক যুগে গৃহে পালন করা হতো, যার বর্তমান নাম ছাগল।
এগুলোকে পৃথিবীর প্রাচীনতম গৃহপালিত প্রাণীর প্রজাতিগুলোর মধ্যে একটি। এসব প্রাণীকে কুকুর আক্রমণ করতো। যুগ যুগ ধরেই ছাগল একটি নীরিহ প্রাণী হিসেবে পরিচিত।
ক্রল ডট ইন থেকে জানা যায়, ভারতের জাতির জনক মাহাত্ম গান্ধী কোন এক সময় গরু ও মহিষের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য ভোগ করা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
তবে মজার ব্যাপার হলো তিনি ছাগলের দুধ ছাড়েননি। এছাড়া অন্যান্য গবাদি পশু থেকে ছাগলের প্রতি আলাদা কদর করতেন মাহাত্ম গান্ধী। বিভিন্ন সমাবেশে তার সঙ্গে ছাগল দেখা যেত।
কম ল্যাকটোজ ও প্রক্রিয়া করা সহজ:
ছাগলের দুধ এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠার পেছনে এর স্বাস্থ্যগত কারণও রয়েছে। প্রথম ও প্রধান কারণ হচ্ছে বিশ্বের জনসংখ্যার ৬৫ ভাগই ল্যাকটোজ এর ওপর নির্ভরশীল। যা গরু বা অন্য প্রাণীর দুধে পাওয়া যায়।
তবে ছাগলের দুধে উল্লেখযোগ্য ল্যাকটোজ থাকলেও গরুর দুধের চেয়ে অনেক কম। ছাগলের দুধ হজম করা সহজ বলে স্বাস্থ্য বিদ্যায় প্রমাণ হয়েছে।
তাই যদি ল্যাকটোজ থেকে কেউ দূরে থাকতে চায় তবে ছাগলের পনির ও দুধ খেতে পারেন তাতে হজমের সমস্যা দূর হবে।
মার্কিন স্বাস্থ্য বিষয়ক পত্রিকা হেলথ লাইন অনুসারে, ছাগল ও গরুর দুধের মধ্যে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে।
ছাগলের দুধে প্রতি কাপ গরুর দুধের চেয়ে ২০ বা তার বেশি ক্যালোরি, প্রতি আট আউন্সে এক গ্রাম বেশি প্রোটিন ও ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট ও ক্যালসিয়াম রয়েছে।
স্বাস্থ্য সাইটটি আরও জানায়, ছাগলের দুধ শরীরকে বাইরের পুষ্টি ভালভাবে শোষণ করতে সহায়তা করে আর গরুর দুধ তা করে না।
সাধারণত গরু ও ছাগল উভয় দুধেই পানি, প্রোটিন, চর্বি ও ল্যাকটোজ থাকে তবে ল্যাকটোজ কম থাকায় ও হজমে সহায়ক বলে এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
এদিকে সামার হিল গোট ডেইরি বলছে, সামগ্রিকভাবে ছাগলের দুধ প্রক্রিয়া করা সহজ। ল্যাকটোজ-সংবেদনশীল লোকদের দূরে রাখাসহ শরীরকে প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, খনিজ এবং ভিটামিন সরবরাহে ছাগলের দুধের জুড়ি মেলা ভার।
তথ্যসূত্র: টেস্টিং টেবিল, হেলথ লাইন, ইনস্টিটিউট ফর গোট রিসার্চ, দ্য সায়েন্স এগ্রিকালচার, সায়েন্স অ্যালার্ট