সাহিত্যের ইতিহাসে অনেক লেখক, কবি ও নাট্যকার দেশের বৈরী পরিবেশে নিরাপত্তা না পেয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন। কেউ অল্প সময় স্বদেশে ফিরেছেন; কেউ আর ফিরেনি।
তেমন কয়েকজনের দেশত্যাগের কথা নিয়েই এই নিবন্ধন।
লর্ড বায়রন: লেডি ক্যারোলিনল্যাম তাঁর প্রেমে পড়েন
রোমান্টিক কবি লর্ড বায়রন দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে কাটাতে বাধ্য হন। তাঁর পুরো নাম জর্জ গর্ডন লর্ড বায়রন।১৮১২ সালে বায়রনের ‘চাইল্ড হ্যারল্ড’ প্রকাশের পর লন্ডন সাহিত্য মহলে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে যায়।
তখন আইরিশ কথা সাহিত্যিক লেডি ক্যারোলিনল্যাম বায়রনের প্রেমে পড়েন। বায়রনের মতো বেপরোয়া প্রেমিকের চেয়েও মারাত্মক আক্রমণাত্মক ছিলেন ক্যারোলিন। বায়রনের ওপর চড়াও হলে বায়রন তাঁর প্রতি বিরক্ত হন।
তাঁর সঙ্গে মাত্র ছয় মাসের প্রেমের ইতি টানেন বায়রন। অপমানের প্রতিশোধ নিতে ক্যারোলিনও বায়রনকে ‘ম্যাড, ব্যাড অ্যান্ড ডেঞ্জারাস টু নো’ বলে সমাজে ছোট করার চেষ্টা করেন।
তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের বদনাম আরো জোরালোভাবে ছড়িয়ে দেন ক্যারোলিন। শেষ পর্যন্ত বায়রন ইংল্যান্ড ছাড়তে বাধ্য হন। পরে বেশির ভাগ নারীকে অবজ্ঞার চোখেই দেখেছেন বায়রন।
এমিল জোলা: গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে লন্ডন যান
১৮৯৮ সালে ফরাসি সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ড্রেফাসের বিরুদ্ধে তথাকথিত মামলায় তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষিত হয়। এর পর ফরাসি লেখক এমিল জোলা তাঁর খোলা কলাম ‘জ একিজ’-এ বিচারব্যবস্থা ও সরকারের সমালোচনা করেন।
তাঁর খোলা চিঠিতে ফরাসি সমাজে প্রচলিত ইহুদিবিরোধী মনোভাবেরও সমালোচনা করেন। স্বভাবিকভাবেই সরকার ও পুলিশ বাহিনী তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়। তারপর গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে লন্ডন যান জোলা।
ড্রেফাসের ঘটনা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আর প্যারিসে ফেরেননি জোলা, লন্ডনেই নির্বাসিত জীবন যাপন শুরু করেন এই লেখক।
ভিক্টর হুগো: তৃতীয় নেপোলিয়নের চক্ষুশূল হয়ে পড়েন
ভিক্টর হুগো জীবনের বড় একটি অংশ বিষণ্নতায় কাটিয়েছেন। পুরো নাম ভিক্টর মারি হুগো। তাঁর লেখায় রাজনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় প্রকাশ করার কারণে তৃতীয় নেপোলিয়নের চক্ষুশূল হয়ে পড়েন হুগো।
এক সময় ক্ষমা পেয়ে গেলেও আর যুক্তরাজ্য ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে যাননি হুগো। সামাজিক অবিচারের কথা তুলে ধরে লেখা তাঁর বিখ্যাত বই ‘লা মিজারেবল’ লেখেন ইংল্যান্ড থেকে।
আর নির্বাসনের আগে ফ্রান্সে থাকাকালে এই অবিচারের বিরুদ্ধেই সোচ্চার থেকে ভিক্টর হুগো লড়াই করেছেন অবিচারের বিরুদ্ধে।
অস্কার ওয়াইল্ড: অশোভন আচরণের অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হন
দেশত্যাগ করায় বড় ধরনের নেতিবাচক পরিবর্তন আসে অস্কার ওয়াইল্ডের জীবনে। অশোভন আচরণের অপরাধে তাঁর সাজা হয়। জেলে থাকার সময় তাঁর স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হয়।
ছাড়া পাওয়ার পর তিনি প্যারিসে চলে যান। আবার লেখালেখি শুরু করেন। সে সময়ের লেখার ফসল হলো ‘দি ইম্পর্ট্যান্স অব বিইং আর্নেস্ট’।
তবে বেশিদিন লেখা চালিয়ে যেতে পারেননি অস্কার ওয়াইল্ড। লেখার আনন্দ হারিয়ে ফেলার কারণেই এমনটা হয়েছে।
শুধু লেখার আনন্দ পাচ্ছেন না বলে লেখা ছেড়েছেন এমনটা নয়। বরং জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট পেয়েছেন বলেই আর লেখার শক্তি তার অবশিষ্ট নেই বলেও মত দিয়েছেন অনেকে।
বের্টল্ড ব্রেখট: আমেরিকায় থিতু হন
অন্যদিকে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৩৩ সালে বের্টল্ড ব্রেখট জার্মানি ছাড়েন। প্রথমে সুইডেনে পরে ১৯৪০ সালে আমেরিকায় চলে যান।
অন্যান্য জার্মান লেখকের মতো তিনিও দেশে থাকলে সমস্যায় পড়তে হবে তা ভালোভাবেই জানতেন। আমেরিকায় গিয়ে চলচ্চিত্রের কাহিনিকার হিসেবে ভালো সফলতা পান তিনি।
তবে সেখানে স্থায়ীভাবে থিতু হননি। ইউরোপে ফিরে আসেন, তবে জার্মানিতে নয়, প্রথম প্রবাস সুইডেনেই ফিরে আসে বের্টল্ড।
ডি এইচ লরেন্স: আর্নেস্ট উইকলির স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম
ব্রিটিশ লেখকদের মধ্যে অসাধারণ জীবন যাপন করেছেন ডি এইচ লরেন্স। তার পুরো নাম ডেভিড হার্বার্ট লরেন্স। কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ার প্রথম কারণ হলো তিনি যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। সে কারণেই তাঁর বই প্রকাশ করাও কঠিন ছিল।
আবার তাঁর বইয়ের রসদ হজম করা তখনকার সমাজের বিশেষ একটা অংশের জন্য কঠিন ছিল। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘লেডি চ্যাটারলিস লাভার’ তাঁর স্বদেশসহ আরো অনেক দেশে দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছিল।
ইংল্যান্ড ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার পর ডি এইচ লরেন্স দীর্ঘদিন কাটান অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও ফ্রান্সে।
লরেন্সের দেশত্যাগ করার আরো একটা মজার কারণ আছে। সেটি হলো, ইউনিভার্সিটি কলেজ নটিংহামের সাবেক শিক্ষক আর্নেস্ট উইকলির স্ত্রী ফ্রিডা উইকলির সঙ্গে প্রেমে পড়া।
আরো পড়ুন: কাজী নজরুল-নার্গিস আক্তার ট্র্যাজেডি
তাঁর চেয়ে ছয় বছরের বড় ফ্রিডার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় ১৯১২ সালে। লরেন্সের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার সময় ফ্রিডার স্বামীর ঘরে তিনটি সন্তান ছিল।
ফ্রিডার বাবার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই তাঁরা বের হন। কিন্তু তখন জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে বিবাদের বিষয় হয়ে উঠেছে এমন একটা এলাকায় চলে যান তাঁরা।
লরেন্সকে ব্রিটিশ গুপ্তচর বলে গ্রেপ্তারও করা হয়। পরে অবশ্য ফ্রিডার বাবার সহায়তায় মুক্ত হন তিনি। সেখান থেকে মধুচন্দ্রিমা উদযাপন করার জন্য মিউনিখের উদ্দেশে যাত্রা করেন দুজন।
পাবলো নেরুদা: কমিউনিস্টদের অত্যাচারের প্রতিবাদ জানান
চিলির শাসকদের সাথে মতের অমিল থাকায় রোষানলে পড়েন কবি পাবলো নেরুদা। ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে প্রকাশ্যে কমিউনিস্টদের অত্যাচারের প্রতিবাদ জানান নেরুদা।
তারপর তাঁদের সাথে নেরুদার দ্বন্দ্ব আরো জটিল হয়ে ওঠে। শেষে তিনি এক বন্ধুর মদের ভাঁড়ারে লুকিয়ে ছিলেন কয়েক মাস। সেখান থেকে পালিয়ে ইউরোপ যান।
ইউরোপ থেকে ১৯৫২ সালে ফিরলেও সেখানে গিয়েও ভয় কাটেনি তাঁর। কারণ মধ্য ও পূর্ব ইউরোপেও কমিউনিস্টদের ক্ষমতার দাপট দেখতে পান। তাঁর পুঁজিবাদী আদর্শকে ভালো চোখে অনেকে দেখেনি।
জেমস জয়েস: ব্রিটিশ ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন
বড় হওয়ার পরে জীবনের বৃহৎ অংশ দেশের বাইরে কাটিয়েছেন জেমস জয়েস। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরুর পরে ইতালির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিস্তেতে অবস্থান করছিলেন তিনি।
ব্রিটেন ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির চলমান যুদ্ধে ইতালিও জড়িয়ে পড়লে নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ডের জুরিখে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জয়েস।
এক মাস আগেই সেখানে চলেও যান। তবে এই স্থানান্তর স্বস্তির হলো না। তিনি পড়ে গেলেন দ্বিগুণ নির্বাসনে। আইরিশ নাগরিক জয়েসের কাছে তখন ব্রিটিশ পাসপোর্ট।
ওদিকে ত্রিস্তে ত্যাগের সময় অনেকটা প্যারোলের মতোই শর্ত সাপেক্ষে ছাড়া পেয়েছেন। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান কর্মকর্তারা তাঁর যাবতীয় জিনিসপত্র রেখে দিয়ে মুচলেকা নেন।
বিরুদ্ধশক্তিকে কোনোভাবেই সহায়তা করবেন না তিনি। যুদ্ধের পুরো সময় জয়েস দুই পক্ষের নজরদারিতেই থাকেন। একদিকে ব্রিটিশ বাহিনী, অন্যদিকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান গোয়েন্দা বিভাগ তাঁকে চোখে চোখে রেখেছে। সে সময় জয়েস মানসিক ও শারীরিকভাবে কষ্টে ছিলেন।
মিলান কুন্ডেরা: চেকোস্লোভাক কমিউনিজমের সংস্কারের ওপর জোর দেন
মিলান কুন্ডেরা ১৯৬৭ সালের জুনে অনুষ্ঠিত চেক লেখকদের ফোর্থ কংগ্রেসে যোগ দেন। সেখানে তিনি জোরালো বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে ইউরোপীয় প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার বিষয়ে চেকবাসীর ভূমিকার ওপর জোর দেন।
এ সময় চেকোস্লোভাক কমিউনিজমের সংস্কারের ওপর জোর দেন মিলান কুন্ডেরা। এতে ১৯৬৮ সালে তৎকালীন চেক সরকার তাঁর বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
তখন তিনি প্রথমবারের মতো প্যারিস যাত্রা করেন এবং সে সময় প্রকাশক ক্লড গালিমার্ডের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়।
কুন্ডেরা দেশে ফিরে আসার পর গালিমার্ড বেশ কয়েকবার চেকোস্লোভাকিয়ায় তাঁর সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি কুন্ডেরাকে ফরাসি নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য উৎসাহ দেন।
তিনি চেকোস্লোভাকিয়া থেকে কুন্ডেরার ‘লাইফ ইজ এলসহয়ার’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি গোপনে প্যারিসে নিয়ে যান। শেষে কুন্ডেরা গালিমার্ডের কথায় রাজি হয়ে ১৯৭৫ সালে ফ্রান্সে চলে যান।
১৯৭৯ সালে তাঁর চেক নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে গেলে মিলান কুন্ডেরা ফ্রান্সের রেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর অধ্যাপনা করেন। ৩ বছর পর প্যারিসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন কুন্ডেরা।
গাও জিং জিয়ান: রাজনৈতিক নাটক ‘ফিউজিটিভ’ ও তাঁর সত্যিকারের নির্বাসন
একই কারণে নোবেলজয়ী কথা সাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রকর, সাহিত্য সমালোচক গাও জিং জিয়ান বাধ্য হয়েই চীন ছেড়ে ফ্রান্সনিবাসী হন। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ফ্রান্সে বাস করছেন চীনা এই লেখক।
১৯৮৯ সালের রাজনৈতিক নাটক ‘ফিউজিটিভ’ অন্য নামে ‘এক্সাইল’ মানে ‘নির্বাসন’ তাঁর সত্যিকারের নির্বাসনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আরো পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের গল্পে নির্মিত সিনেমাগুলো
এর কাহিনীতে বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সালের ৪ জুন তিয়ানআনমেন স্কয়ারে একটি ট্যাংক আসে। এরপর ৩ জন মানুষ পালিয়ে আশ্রয় নেয় একটা বড়ো গুদাম ঘরে।
এই নাটক আলোর মুখ দেখার পর থেকেই জিংয়ের সব লেখাসহ তাকেও চীনে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান গাও জিং জিয়ান।