সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীটা একদিকে যেমন রহস্যময় অন্যদিকে অপরুপ সৌন্দর্য্যে ঘেরা। পৃথিবীর তেমন এক বিস্ময়কর ও বৈচিত্রপূর্ণ নাম প্রশান্ত মহাসাগর।
আয়তনে ও গভীরতায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাসাগর এটি। এর আয়তন প্রায় ১৬ কোটি ৫২ লাখ বর্গকিলোমিটার, যা সমগ্র বিশ্বের ভূমি পৃষ্টের চেয়েও বড়।
পুরো পৃথিবীর ভূ-পৃষ্টের আয়তন প্রায় ১৫ কোটি বর্গকিলোমিটার। পৃথিবীর পুরোটাই প্রশান্ত মহাসাগরে অনায়াশে ডুবিয়ে দেয়া যাবে।
এর গড় গভীরতা ৪ হাজার মিটার। এ মহাসাগরের সর্বোচ্চ গভীরতা মারিয়ানা খাত। এই খাতের গভীরতা প্রায় ১০ হাজার ৯২৮ মিটার।
পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টকে এর গভীরতায় ফেলে দেওয়া হলে এটি ডুবেও এর উপড়ে আরো ৩ কিলোমিটার পানি থাকবে।
পৃথিবীর মোট পানির মজুদের প্রায় ৪৬ ভাগ পানি এ মহাসাগর ধারণ করে। পৃথিবীর ৫ টি মহাদেশ এর তীরে অবস্থিত।
এর পূর্বদিকে দুই আমেরিকা মহাদেশ। পশ্চিমে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ আর এর দক্ষিণে রয়েছে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ।
ছোট বড় প্রায় ৩২ টি উপসাগর রয়েছে প্রশান্তের বুকে। অস্ট্রেলীয় ভূমধ্যসাগর, আলাস্কা উপসাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, পূর্ব চীন সাগর, জাপান সাগর, পীতসাগর ও জাভা সাগর এর মধ্য উল্লেখযোগ্য।
প্রশান্ত মহাসাগরের নামকরণ করেছিলেন পর্তুগিজ নাবিক ফার্ডিনান্ড ম্যাগেলান। ১৫১৯ সালে পর্তুপাল থেকে স্পাইস দ্বীপকুঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন তিনি।
১৫২১ সাল নাগাদ তার নৌ বহর দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণ প্রান্ত পেরিয়ে এই মহাসাগরে এসে পড়েন।
তবে যাত্রা পথে তার নৌ বহর নানা প্রতিকূলতা ও বিপজ্জনক আবহাওয়া পেরিয়ে যখন এক শান্ত জলরাশিতে এসে পড়ে।
তখন নাবিক ফার্ডিনান্ড ম্যাগেলান এই সাগরের পানির স্থিরতা ও অতিশান্ততা দেখে এর নাম দেন মার প্যাসিফিকো। পর্তগিজ ও স্প্যানিশ দুই ভাষাতেই যার অর্থ দাঁড়ায় প্রশান্ত মহাসাগর।
প্রশান্ত শব্দের অর্থ শান্তি হলেও এ মহাসাগরে সারা বছর অশান্তি লেগে থাকে। পৃথিবীতে যত ভূমিকম্প হয় তার ৯০ ভাগই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে হয়।
ভূমিকম্প, অগ্নুৎপাত, ঘূর্ণিঝড়ের মতো বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টিতে সবার উপরে থাকে এ মহাসাগর। এ মহাসাগরের তলদেশ ও তীরবর্তী এলাকায় ৪৫০ টিরও অধিক সক্রিয় আগ্নেয়গিরির অবস্থান, যা পৃথিবীর প্রায় ৭৫ ভাগ।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সামুদ্রিক জীব এ মহাসাগরে বসবাস করে। তিমি, ডলফিন ও হাঙ্গরসহ নানান ধরনের সামুদ্রিক প্রাণির বসবাস রয়েছে প্রশান্তের বুকে।
পৃথিবীর মাছের চাহিদার প্রায় ৭০ ভাই এই মহাসাগর যোগান দিয়ে থাকে। সালমন, সার্ডিন, কুড, মারলিন, টোনা ও হ্যারিন এই মহাসাগরের উল্লেখযোগ্য মাছ।
এই মহাসাগরের তীরের মানুষেরা এই ধরনের মাছ খেয়ে জীবন ধারণ করেন। তাছাড়া মাছ রপ্তানি করেও বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন।
এ মহাসাগরে প্রায় ২৫ হাজার দ্বীপ রয়েছে, যা বাকি চার মহাসাগরের সম্মিলিত দ্বীপ সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। দ্বীপগুলো মাইক্রোনেশিয়া, মেলানেশিয়া ও পলিনেশিয়া এই তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত।
মাইক্রোনেশিয়ান অঞ্চলের দ্বীপপুঞ্জগুলো তুলনামূলক ক্ষুদ্রাকৃতির। এই দ্বীপগুলোর মধ্যে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, ক্যারোলিন দ্বীপপুঞ্জ ও কিরিবাতি উল্লেখযোগ্য।
মেলানেশিয়ান অঞ্চলের দ্বীপপুঞ্জগুলো মাঝারি আকৃতির। নিউ গায়ানা এর সর্ববৃহৎ দ্বীপপুঞ্জ। এছাড়া ফিজি, ভানুয়াতু, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এবং সান্তাক্রুজ উল্লেখযোগ্য।
পলিনেশিয়ান অঞ্চলের দ্বীপপুঞ্জগুলো বৃহৎ আকৃতির। ১৩০ টি দ্বীপ নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত, যা উত্তরে হাওয়াই দ্বীপ থেকে দক্ষিণে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত।
এ অঞ্চলের দ্বীপগুলোর মধ্যে সামোয়া, টুভালু, টোংগা, পূর্ব দ্বীপপুঞ্জ এবং কুব দ্বীপপুঞ্জ উল্লেখযোগ্য।
এ মহাসাগরের মাধ্যমেই পৃথিবীর নানান দেশের মধ্যে আমদানী-রপ্তানি এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে আসছে।
বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশ সমুদ্রপথেই সম্পাদিত হয়। তাই বাণিজ্যিক দিক থেকে এই মহাসাগরের গুরুত্বও অপরিসীম।
আমেরিকা, চীন, রাশিয়া থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়া, ম্যাক্সিকো ,অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া ও কানাডাসহ বিশ্বের ৫৫টি স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব দেশ রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের দুই তীরে।
প্রশান্ত মহাসাগরের একদিকে যেমন আমেরিকার অবস্থান, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে চীন, জাপান ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো। তাই এই সমুদ্রসীমায় সবচেয়ে বেশি সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়াম ও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে মার্কিনীরা বড় ধরনের সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে। চীনও সাগরের বুকে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে।
এছাড়া সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে জাপানের সাথে চীনের বিরোধিতা রয়েছে।
আরেকদিকে পরমাণু শক্তিধর উত্তর কোরিয়া মার্কিন গুয়াম দ্বীপে মার্কিন নৌ ঘাঁটিতে হামলার হুমকি দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তায় বড় ধরনের উত্তেজনা তৈরি করেছে।
পৃথিবী যত আধুনিক হচ্ছে তত দূষিত হচ্ছে এ মহাসাগর। হারাচ্ছে তার জীব বৈচিত্র্য। পৃথিবীর সব কল-কারখানার বর্জ্য ও যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, মাছ ধরার জাল নদীগুলোর মাধ্যমে এ মহাসাগরে পতিত হয়।
এসব কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দূষণের মাত্রা। তাতে হুমকিতে পড়ছে জলজপ্রাণি ও জীববৈচিত্র।