সেতু-ফারুক-কাব্য

সেতু-ফারুক কাব্য

হঠাৎ একটি সংবাদ উপস্থিত ১০/১২ জনের মনকে খারাপ করে দিলো। এর ঠিক ১০ মিনিট পর একই ব্যক্তির মাধ্যমে যে সংবাদটি আসে তা শুনে সবার চোখ মুখ ছানাবড়া হয়ে যায়। প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে অন্য আরেকটি সূত্র হতে একই সংবাদ আসায় তা বিশ্বাস না করার কোন উপায় ছিল না।

সংবাদটা শুনে উপস্থিত নারীদের চোখে অশ্রু বারি ঝরে পড়ে। আর পুরুষদের চোখ বেয়ে অশ্রু না ঝড়লেও অন্তরের ভেতরে কান্নার জোয়ার শুরু হয়ে যায়। এমন একটি সংবাদ আসবে এটা কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি। প্রথমে আমি খবরটা সাদিয়াকে (আমার স্ত্রী) দেই। শুনে প্রথমে সে বিশ্বাস করে না সেতু ভাবী নেই।

কারণ গতকালই বলেছি আইসিইউ থেকে ভাবীকে বের করে আনা হয়েছে। এখন বাবু ও ভাবী দুজনই ভালো আছে। তার একদিন পরই ভাবী না ফেরার দেশে চলে গেছে এমন খবর মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। সাথে সাথে সাদিয়ার কান্নার শব্দ শুনতে পাই। বলছিলাম ওমর ফারুক ভাইয়ের সহধর্মীনী সেতু ভাবীর কথা।

না ফেরার দেশে ভালোবাসার সেতু

গত ২৬ মে-২০২২ রোজ বৃহস্পতিবার না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ফারুক ভাইয়ের নয়নমণি ও ভালোবাসার স্ত্রী সেতু। চার বছর ধরে ফারুক ভাইকে আমি চিনি। যতবারই দেখা হয়েছে সব সময় ভাবী ও তার বড় কন্যা আরবির কথা বলতেন। স্ত্রী কন্যাকে খুবই ভালোবাসেন তিনি। শুধু তাই না বাবা-মায়ের প্রতিও উনার অগাধ ভালোবাসার প্রতিফলিত হয় সারাক্ষণ।

গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর। ভাবীও ফরিদপুরে সমাজ কল্যাণ অফিসে সরকারি চাকুরি করতেন। ফারুক ভাই কর্মসূত্রে ঢাকা থাকলেও তার মন পরে থাকতো গ্রামে বাবা-মা-প্রিয় স্ত্রী সেতু ও কন্যা আরবির প্রতি। স্ত্রীকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন। এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ভাবীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে উনার পরিচিত, অনুরাগী, ভক্তবৃন্দ, শুভাকাঙ্খী ও হিতাকাঙ্খীরা সবাই নবাগত পুত্র সন্তানের হিসাব মিলাতে পারে না।

তারমীম জাহান সেতু ও ওমর ফারুক
তারমীম জাহান সেতু ও ওমর ফারুক

কি হবে আগত এই শিশুর। সাত মাসের মাথায় দুনিয়াতে আগমন ঘটে ছোট বাবুর। ওমর ফারুক ভাইয়ের নবগত পুত্রকে কে দেখবে, কে তাকে বড় করবে, কিভাবে সে টিকে থাকবে দুনিয়াতে। বড় মেয়েটাও এতো বড় হয়নি যে নিজে নিজে চলতে পারে। এসব প্রশ্ন সেদিন ঘুরপাক খাচ্ছিল সবার মনে। আমি সারারাত এই হিসেবে কষতে কষতে ঘুমাতেই পারিনি।

হায় রে নিয়তি

পরের দিন ফারুক ভাইয়ের পরিচিত সবার মুখে একই কথা শুনি। সবাই ওই প্রিমেচিউড ও মাসুম নিস্পাপ বাবুর হিসেব মেলাতে মেলাতে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিয়েছে। হায় রে নিয়তি। বাবুটাকে দেখারও সুযোগ পেল না তার গর্ভধারিণী মা। সৃষ্টিকর্তা এটা কি করলেন? হঠাৎ কেন মা ছাড়া করলেন বাবুটাকে এমন নানান ধরনের প্রশ্ন সবার মাঝে উদ্রেক হয়। তবে আবার অনেকে বলে সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন,মঙ্গলের জন্য করেন।

সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়াতেন ফারুক সেতু দম্পতি
সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়াতেন ফারুক সেতু দম্পতি

ওমর ফারুক ভাই সেতু ভাবীকে অনেক ভালোবাসে এটা বুঝতাম তবে ভাবীকে কখনো সরাসির দেখিনি বলে তার ভালোবাসার গভীরতাটা হয়তো পরিমাপ করা সম্ভব হয় শুধু অনুমান নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু সেতু ভাবী ও ফারুক ভাইকে কাছ থেকে উপলব্ধি করেছেন ফরিদপুরে স্বনামধন্য লেখক ও সাহিত্যিক পীযূষ সিকদার।

স্ত্রীকে এতো ভালোবাসা যায়

সেতু ভাবীর প্রতি ফারুক ভাইয়ের ভালোবাসার গভীরতা মাপকাঠি পাওয়া যায় ওই লেখকের একটি নিবন্ধ থেকে। পীযূষ সিকদারের ‘‘স্ত্রীকে এতো ভালোবাসা যায়?’’ শিরোনামের একটি লেখনি থেকে জানা যায় ফারুক ভাই সত্যিকার অর্থে কতটা ভালোবাসতেন তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী সেতুকে।

পীযূষ সিকদারে লিখেছেন, ‘‘আমাদের বিপদ আর যায় না। এইতো ২৬ মে বৃহস্পতিবার আমাদের সেতু আমাদের ছেড়ে চলে গেলো! একের পর এক বিপদ। এই বিপদ সন্ধিকালে শিল্পকলায় ওমর ফারুকের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। আমার বড় ভাই নির্ভিক সাংবাদিক প্রবীর সিকদার যখন জেল খানায়।

ওমর ফারুক আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এলো। ওমর ফারুক সরকারি একটি সংস্থায় চাকরি করে। এতো ভালো ছেলে আমি খুব কমই দেখেছি! ওমর ফারুক ও আমি সেতু, সেতু টেনে দেয়। ওমর আমার ছোট ভাই। কিন্তু বন্ধুত্বে অতুলনীয়। সেই কবে থেকে একটানা বন্ধুত্ব চলছে। কখনোই ভুল বোঝাবোঝির অবকাশ ছিলো না। হঠাৎ ওমরের জীবনে ঝড় বহে গেলো।

তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মারা গেলো। আমিই নিজেকে বুঝ দিতে পারছি না আর ওমর কিভাবে নিজেকে বুঝ দেবে! স্ত্রীকে এতো ভালোবাসা যায় ওমর ফারুক তার উদাহরণ। প্রতি সপ্তাহে ওমর ফারুক ঢাকা থেকে বাড়ি আসে। স্ত্রী কন্যা নিয়ে গ্রামের বাড়ি যায়। চলে ভ্রমন ও আড্ডা। এই তো সেদিন ওমরের স্ত্রী( তারমীম জাহান সেতু ) কন্যা ( আরবি ) নিয়ে কানাইপুর এলো। আমার আনন্দ আর ধরে না!

অহমিকা কাজ করে না
প্রাণপ্রিয় স্ত্রী সেতু ও কন্যা আরবির সঙ্গে ওমর ফারুক
প্রাণপ্রিয় স্ত্রী সেতু ও কন্যা আরবির সঙ্গে ওমর ফারুক

এতো ভূ-সম্পত্তির মালিক তবুও ওদের মধ্যে অহমিকা কাজ করে না। এখানেই দুজনের বিশেষ্যত্ব। সেতু উঁচু নীচুর ভেদ বুঝতো না! আমার ভাঙা ঘরে সেতু বসলো ঘর আলোকিত হলো। শত হলেও আমার বোনতো। সেতু যেখানে সেখানে বসতে পারতো।

এটা খেতে হবে ওটা খেতে হবে কোন রকম বাদ বিচার ছিল না। অহংকার নেই কোথাও। তাইতো বড় ভাইয়ের সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও আনন্দে পা নাচায়! সেতু যেমন ভাগ্যবান তেমনি ওমর ফারুকও ভাগ্যবান। ওমর তো সমস্ত ঘরজুড়ে সেতু সেতু ডাকতে ডাকতে পাগল! আমি দূর থেকে দেখতাম। এত ভালোবাসে মানুষ কেমন করে! আমি দূর থেকে অপলক চেয়ে দেখতাম। আরবি মা মা বাবা বাবা বলতে এগিয়ে আসতো।

সুখের সংসার! আমার ভেতর একটা বোধের জন্ম হলো! ভালবাসায় ভাগ্য ফেরায় কথাটা কতটুকুন সত্য! সেতু চলে গেলো! ভাগ্যই যদি ফিরায় এ কিসের আলামত! সেতু চলে গেলো!!! ওমর ফারুকের কলিজায় টান লাগে। আমি যখন সেতুর মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। ওমর কিভাবে মেনে নেবে! সেতু বোন আমার, আমাদের না বলেই চলে গেলি! তোর বাড়িতে গেলে টেবিল ভরে যেতো খাবার-এ।

আমি আশ্চর্য হয়ে বলতাম এতো খাবার! ফারুক-সেতু হেসে দিয়ে বলতো, আমরা খাবো না! আমার ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে গেলো! গোটা কয়েক দিন আগেই পরিষ্কার মনে আছে। সর্ষে ফুল দেখার জন্য সেতু আসে। সেতু চোখে মুখে বাহারি নাচন তোলে! সেতুও চাকরি করতো ওমরও চাকরি করতো। একদিন জানা গেলো ওরা গাড়ি কিনেছে! এ অনুভূতি আমাকে নাচায়ে ছেড়েছে।

এ আনন্দ আমি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার লিখে আনন্দ বোঝাতে পারবো না। আমি গাড়িটা আলতো করে ছোঁই! আরবি গ্লাসের পেছন দিয়ে তাকায় আমরা চলে যাচ্ছি! কাকু, তুমি? আমার যাওয়া হয় না! সারাদিন আমার ঘোরে কেটেছে! আনন্দ-উচ্ছাসে। সর্ষে ফুলের দিকে তাকাই মনটা কেবলই রবীন্দ্রসংগীত হয়ে বাজে। আমার দাদা জেলে না গেলে হয়তো ওমরের সাথে আমার পরিচয় হতো না! বন্ধুত্ব হতো না! চালের পয়সা, দুধের পয়সা নিতাম না। ওমর ফারুক আমার দুর্দিনের বন্ধু।

পীযূষ সিকদার, ওমর ফারুক ও পরলোকগত সেতু
পীযূষ সিকদার, ওমর ফারুক ও পরলোকগত সেতু

আমার ছেলে পৃথ্বিরাজ জন্ম নিল ঢাকার বনশ্রী ফরাজী হাসপাতালে! ওমরের মুখখান আমি দেখেছি! মনে ভাবি আমার কেউ নয় তবু কত আপন! পৃথ্বিরাজের জন্য কী আনে নাই, তার ফিরিস্তি দেয়া কঠিন! সেতু নেই! ভাবতেই শিউরে উঠছি। আহারে সেতু তুই ক্যান গেলি ওমর ফারুককে রেখে! নাকি এতো ভালোবাসা ধারন করতে পারো নাই। কেন গেলি সেতু? নাকি বধির হয়ে গেলি!

সেতু যেখানেই থাকো ভাল থেকো! সেতু বোন আমার, তোমার নামটাই এতো সুন্দর যে, আমাদের তিনজনের মধ্যে সেতু এঁকে দিয়ে চলে গেলে পরপারে। বারবার একই কথা লিখছি রিপিটেশন করছি যে সেতু আমার বোন। ওর বাড়িতে গেলেই চাঁদমুখ হতাম। ও যে এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে ভাবিনি। এখন আরবি শূণ্য ঘরে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে! মা মা বলে ডাকছে। ওদের জানার কথা না ওদের মা তাঁরা হয়ে জ্বলছে। ওমর কষ্ট পাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি।

ওমরের পৃথিবী একটাই সে সেতু! আরবি এলো। আনন্দের ঢেউ লাগে নিজ গ্রামে! আরেকটি পুত্র সন্তান আসার মধ্য দিয়ে সেতু অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়! ওমর এ কষ্ট ভুলবে কেমনে? শিল্পকলা জানে আমি আর ওমর। ওমর আর আমি । চায়ের দোকানে ধূয়ার গোল বৃত্ত আঁকতাম! প্রতি বিকেলে ওমরের জন্য অপেক্ষা করতাম। ওমর ফারুকও তাই! গল্পে গল্পে উঠে আসতো সেতু শুধুই সেতু।

হাস্যজ্জল সেতু ও ওমর ফারুক
হাস্যজ্জল সেতু ও ওমর ফারুক

আমি নির্বাক হতাম এতো ভালোবাসা কাউকে ভালোবাসা যায়! যেমনটি ভালোবাসা যায় একি শুধু গল্প? একেবারে না। সেতু নেই! সেতু আছে। থাকবে আজন্ম তিল তিল করে। আরবি ও নবজাতক পুত্র সন্তানের কী হবে? এ জমানায় কেউ কাউকে ভালবাসে সে ভালোবাসায় মধ্যে কোন অমৃত-সুধা নাই।

ওমর ফারুক ভালোবাসে ভালোবাসে। ও যে ভালোবেসে জানান দিতো ভালোবাসা ছাড়া কোন পথ নাই। এক সময় অর্থ ও অসুস্থতার কারণে আমি গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের কানাইপুরে চলে আসি। ওমরের সাথে তাতে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। মাঝে মাঝে সাদা গাড়িতে চলে আসতো আমার দোকান চর্যাপদে।

শত ব্যস্ততার মাঝেও স্বজনদের সময় দিতেন ফারুক ও সেতু
শত ব্যস্ততার মাঝেও স্বজনদের সময় দিতেন ফারুক ও সেতু

ওমর আর কী আসা হবে সাদা গাড়ীতে চড়ে সর্ষে ফুল দেখার জন্য? আর কোনদিন গাড়ির পাল্লা খুলে সেতু বেরুবে না! বেরুবে না আরবি!! সেতু তুই যে আমার বোন। তুই যে চলে গেলি আমাদের দুই কুল ছাপিয়ে! ভালো থেকো সেতু। যেখানেই থাকো ভালো থেকো।

স্রষ্টার কাছে আমার চাওয়া সেতু জান্নাতবাসী হোক। সেতু তোমার বন্দনায় আমরা পঞ্চমুখ। সেতু তোমার সারা শরীরে সর্ষে ফুলের ঘ্রাণ লেগে আছে। হলুদে হলুদে তুমি চাঁপাফুল হয়ে ফোঁটো।’’

ওমর ফারুক ভাই ও সেতুর ভাবীর ভালোবাসার গল্প হয়তো একজীবনে শেষ হবে না। সেতু ভাবীর দেয়া নবাগত পুত্র সন্তান ও কন্যা আরবিকে নিয়েই ফারুক ভাইয়ের দিনরাত অতিবাহিত হচ্ছে। শিশু বয়সেই মা হারানো বড় কন্যা আরবিকে অনেক সময় দিচ্ছেন ফারুক ভাই। ওইদিকে ছোট পুত্র এখনো স্কয়ার হাসপাতালের এনআইসিইউতে রয়েছে।

জানি না বিধাতা ওই বাবুর ভাগ্যে কি রেখেছে। কবে ফারুক ভাই তার প্রিয় স্ত্রী সেতুর দেয়া উপহার পুত্র সন্তানকে কোলে নিতে পারবেন। যদি দ্রুত সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে বাবার কোলে আসে তাহলে কিছুটা হলেও বিক্ষিপ্ত বাবার মন সন্তানকে কোলে নিয়ে কেন্দ্রীভূত করতে পারবেন।

হে সৃষ্টিকর্তা, হে পালনকর্তা। আপনার কাছে ফরিয়াদ ফারুক ভাইয়ের পুত্রকে দ্রুত সুস্থ করে বাবার কোলে ফিরিয়ে দিন। তাতে স্ত্রী হারানোর যন্ত্রণা কিছুটা হলেও কমবে ফারুক ভাইয়ের।

কলমে: মোহাম্মদ রবিউল্লাহ, সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট ও অনুবাদক।