চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা করতে গিয়ে একটা বিষয় অদ্ভূত লাগে। চলচ্চিত্রের অনেক তারকাকে দেখি সালমান শাহ ‘র প্রসঙ্গ আসলে বিরক্ত হন। অনেকে মুখ খুলতে চান না।
সেইসব তারকাদের বেশিরভাগই রিয়াজ-ফেরদৌস যুগের আগের। রিয়াজ ও ফেরদৌসকে বরাবরই সালমানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দেখেছি।
সালমানের স্টারডম, হিরোইজম, স্টাইল নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করতে দেখেছি। আর তাদের পরবর্তী জেনারেশনে যারা এসেছেন তারা তো প্রায় সবাই সালমানকে নিজেদের আইডল হিসেবে মানেন। সময়ের সেরা ব্যবসা সফল নায়ক শাকিব খানও বহুবার সালমানকে নিজের প্রিয় নায়ক বলেছেন।
সালমানের প্রতি বিরক্ত যারা তাদের মধ্যে অন্যতম দুইজন হলেন মিশা সওদাগর ও মিয়াভাই খ্যাত নায়ক ফারুক। বেশ অনেকবারই তারা সালমান শাহকে নিয়ে কটু কথা বলেছেন।
সম্প্রতি সালমান শাহকে ইচ্ছে করে খাটো করতে গিয়ে শাকিবকে (তিনি শাকিবকেও পছন্দ করেন না। সালমানকে ছোট করতে শাকিবের কাঁধে পা দিয়েছেন মাত্র) কিছু কটু কথার বক্তব্য দিয়েছেন ফারুক সাহেব। গেল দুই তিনদিন ধরে অনেকেই ইনবক্সে সেই ভিডিও ক্লিপটি পাঠিয়ে বিস্ময়-ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। অনেকে বিভিন্ন কমেন্টস বক্সে আমাকে ম্যানশন দিয়েছেন। জানতে চেয়েছেন – কেন তারা এমন করেন? সালমান শাহকে ছোট করে কথা বলেন?
আসলে এ বিষয়ে আমার কিছু বলার থাকতে পারে না। কারণ ফারুক সাহেব সালমান শাহকে বা তার ঐতিহাসিক জনপ্রিয়তাকে পছন্দ করেন না সেটা জানি। তো তিনি সালমানকে নিয়ে বাজেভাবে বক্তব্য দেবেন সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তিনি হয়তো ভাবেননি যে কোনো এসি চালিত হলরুমে প্রেস কনফারেন্স করে সালমানকে মনে রাখাতে হচ্ছে না, কোনো গিফটের সৌজন্যে সালমানকে মনে রাখাতে হচ্ছে না,
কোনো মিডিয়াবাজি করেও সালমানকে মনে রাখাতে হচ্ছে না। যারা রাখছেন তারা নিজেদের তাগিদে রাখছেন। নিজেদের ভালোবাসার জায়গা থেকে সালমানকে ভালোবাসছেন।
সম্প্রতি ফারুক সাহেবের জন্মভিটা গাজীপুরে একটি রিসোর্ট হয়েছে সালমান-শাবনূর জুটির ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ নামে। সেখানে সালমান শাহের একটি ভাস্কর্যও স্থাপিত হয়েছে। এটি করেছেন রাশেদ খান নামের এক সালমান ভক্ত।
সাংবাদিক হিসেবে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো রিসোর্টটির উদ্ধোধন ও ভাস্কর্যের উন্মোচন অনুষ্ঠানে। সেখানে অতিথি হিসেবে ফারুক সাহেবের নাম দেখে অবাক হয়েছিলাম।
গাজীপুর যাত্রাপথে সহকর্মীদের সঙ্গে বলছিলাম যে আমার বিশ্বাস হয় না সালমানের অনুষ্ঠানে তিনি আসবেন। এবং সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা তিনি করেননি। ফারুক সাহেব যাননি গেল ১৩ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানটিতে।
সালমান বিদ্বেষের এসব কারণ বিশ্লেষণ করাই যেতে পারে। হতে পারে সালমানের মৃত্যুর পরও তাকে নিয়ে এত মাতামাতি হয়তো তাদের গায়ে সয় না। তারা মেনে নিতে পারেন না বা চান না এই ব্যাপারটা।
সালমানের ছবি এখনো হলে আসলে সেখানে ভিড় লেগে যায়। সালমানকে নিয়ে চলচ্চিত্র উৎসব হলে সেটা সবার আগ্রহে থাকে। সালমানকে নিয়ে কোনো একটা নিউজ করলেও সেটা হিটলিস্টে সবার উপরে থাকে।
সালমানকে নিয়ে তার মৃত্যুর ২৪ বছর পর পাগল ভক্ত নিজের জমিতে ভাস্কর্য বানায়, তার সিনেমার নামে রিসোর্ট বানায়! সালমানকে আইডল মেনে গেল দুই যুগ ধরে নায়করা সিনেমায় আসছেন। এইসব দৃশ্য হিংসুটে মনের জন্য হতাশারই বটে।
সালমানই ঢাকাই সিনেমার শেষ কথা নয়। মাত্র ২৭টি ছবি করেছেন। সেখানে ফ্লপ ছবিও আছে কিছু। তবে ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি দিয়ে গেছেন আধুনিকতা, স্টাইল, স্মার্টনিটি, অতি অভিনয় না করে সাবলীল অভিনয়, বড় বড় তারকাদের ভেতরেও নিজের আলাদা হিরোইজম, জনপ্রিয় কিছু জুটি, সবশ্রেণির তরুণদের হলমুখী করার জাদুকরী ক্ষমতা।
সেইসব দানের জন্যই আজও লোকে তাকে মনে রেখেছে। তাকে নায়িকারাও বন্ধু ভাবতেন, ভাল মানুষ হিসেবে জানতেন। এজন্য সালমানের নায়িকারা তার চরিত্রের প্রশংসা করেন সর্বত্র।
যে শাকিব খানের সঙ্গে ফারুক সাহেব সালমানের তুলনা করলেন সেই শাকিব খানের ক্যারিয়ারে অনেক সুপারহিট ছবি আছে। কিন্তু সেখানে কোথাও সালমানের মতো নিজস্বতা নেই, সবশ্রেণির তরুণদের জন্য আইকনিক কিছু নেই।
শাকিব খানের নামের পাশে একটাও কেয়ামত থেকে কেয়ামত নেই, এই ঘর এই সংসার নেই, বিক্ষোভ নেই, বিচার হবে নেই, তোমাকে চাই নেই, চাওয়া থেকে পাওয়া নেই, আনন্দ অশ্রু, জীবন সংসার নেই, স্বপ্নের ঠিকানা (ইন্ডাস্ট্রির দ্বিতীয় ব্যবসা সফল সিনেমা বলা হয় এটিকে) নেই, দেন মোহর নেই, মায়ের অধিকার নেই, প্রেম পিয়াসী নেই, সত্যের মৃত্যু নেই- তাও নেই।
এটাও বলা যেতে পারে তুলনার প্রসঙ্গে- এত এত সিনেমা দিয়েও সালমান অভিনীত জনপ্রিয় গানের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারেননি শাকিব খান।
তবে সালমানের সবচেয়ে বড় অর্জনটা হলো ফারুক, আলমগীর, জসীম, ইলিয়াস কাঞ্চন, নাঈম, রুবেল, ওমর সানী, বাপ্পারাজের মতো তারকাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি সেরা হয়ে উঠেছিলেন। কোনো ফাঁকা মাঠে নয়। তাকে কোনো পলিটিক্স করতে হয়নি। বরং তাকে নিয়ে পলিটিক্স হয়েছে।
নায়ক থেকে সাংসদ হওয়া ফারুক সাহেব অবশ্যই কিংবদন্তি। সারেং বউ যে কোনো অভিনেতার ক্যারিয়ারে সৌভাগ্যের সংযোজন। অন্তত এমন একটা সিনেমা যার দখলে তার মতো অভিনেতাকে অবশ্যই বিনয়ী হিসেবে দেখতে চায় সবাই।
মিয়াভাই সিনেমা পাগল মানুষ। এফডিসি যখন নানা অনিয়ম ও কালো থাবায় আক্রান্ত তখন অসুস্থতা, রাজনৈতিক ব্যস্ততা, ব্যবসায়িক ব্যস্ততার ফাঁকেও তিনি এফডিসিতে আসতেন, চলচ্চিত্রের মানুষদের সাহস যোগাতেন। তাকে আমি সম্মান করি।
তার ভালোবাসার প্রতিদানে অবশ্য চলচ্চিত্রের মানুষেরা ভালোবেসে তাকে সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে। নির্বাচনের আগে অনেক প্রতিশ্রুতিই তিনি দিয়েছেন চলচ্চিত্রের জন্য।
পাশ করার পর সেগুলো প্রায় সবই ভুলে গেছেন। সে নিয়ে আফসোস নেই। তবে অন্তত একটা সিনেমা বানানোর ঘোষণা তিনি দিতে পারতেন প্রযোজক হিসেবে। তা না করে সিনেমা থেকে হাত পা ধুয়ে মুছে উঠে গেছেন তিনি।
তা সে ভালো। কিন্তু এইসব অবান্তর কথা বলে একজন কালজয়ী নায়ককে ছোট করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব ফারুক সাহেবকে মানায় না। নক্ষত্র সালমান শাহের সঙ্গে তারই অনুরাগী শাকিব খানের তুলনা দিয়ে দুই নায়ককে এক কাতারে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টাও তাকে মানায় না।
শাকিব খান ঢাকাই সিনেমায় একটা যুগের সুপারস্টার। আর সালমান শাহ হলেন ঢাকাই সিনেমার স্বপ্নের রাজকুমার। যাকে শুধু মুখে মুখে শুনেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম রূপকথার নায়কের আসনে বসিয়ে রেখেছে এ বাংলার মানুষ……
(কেউ কষ্ট পেলে আমি দুঃখিত। লেখাটা থাকুক। কোনো একদিন হয়তো এটা আজকের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে)
লেখক: সাংবাদিক লিমন আহমেদ