মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কালো মানুষরা সাদা মানুষের তুলনায় বেশি ও কম বয়সে স্ট্রোক করে থাকে। সম্প্রতি “নিউরোলজি” জার্নালে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
মৃত্যুর প্রধান কারণ স্ট্রোক
ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন অনুসারে স্ট্রোক হল মৃত্যুর প্রধান কারণ এবং যুক্তরাষ্ট্রে শারীরিক অক্ষমতার এটি অন্যতম।
ওহাইও এবং কেনটাকির হাসপাতালের দুই দশকেরও বেশি সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে স্ট্রোকের প্রবণতা সম্পর্কে এমন তথ্য বের করেছেন জনস্বাস্থ্য গবেষকরা।
গবেষণার তথ্য বলছে, ১৯৯৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট স্ট্রোকের হার প্রতি ১ লাখে ২৩০ জন থেকে কমে ১৮৮-এ দাঁড়িয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে এই হার প্রতি ১ লাখে ৩৪৯ থেকে ৩১১ ও আর শ্বেতাঙ্গদের ক্ষেত্রে এই হার ২১৫ থেকে ১৭০-এ নেমেছে।
পুরুষ ও নারীদের স্ট্রোকে ভিন্নতা
স্ট্রোকের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে ভিন্নতা দেখেছেন গবেষকরা। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ৭ টি উপসর্গ পাওয়া গেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে স্ট্রোকের হার কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় প্রায় ৫০% থেকে ৮০% বেশি। এই হার কমবয়সী থেকে মধ্যবয়সী কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন: মনিং সিকনেস এর কারণ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির জরুরী ওষুধ ও মহামারী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষণার লেখক ডাঃ ট্রেসি ম্যাডসেন বলেছেন, গবেষণার ফলাফলগুলো কিছু উপায়ে উৎসাহজনক। গত ২২ বছর প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্ট্রোকের হার কমেছে। আগের গবেষণায় এটি দেখা যায়নি।
প্রার্থক্য রয়েই গেছে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে
ডাঃ ম্যাডসেন রোড আইল্যান্ড ও মিরিয়াম উভয় হাসপাতালেরই জরুরী রোগের চিকিৎসক ট্রেসি ম্যাডসেন আরও বলেন, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে গত ২২ বছরে স্ট্রোকের হার কমলেও শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে প্রার্থক্য রয়েই গেছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ উভয়ের মধ্যেই কম বয়সে স্ট্রোক করার প্রবণতা দেখা গেছে, তবে কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে অন্তত ১০ বছর আগে স্ট্রোকের সাথে পরিচয় ঘটে বলেও জানা যায়।
৪১ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ নারী ডিনা পিয়ারসাল জানান, যে তার একবার ইস্কেমিক স্ট্রোক হয়েছিল। চিকিৎসকরা জানান, রক্ত অবরুদ্ধ বা মস্তিষ্কে রক্ত কম গেলে এই ধরনের স্ট্রোক হতে পারে।
চিকিৎসকদের ফলোআপে থাকুন
নেভাদা অঙ্গরাজ্যের লাস ভেগাসে বসবাসকারী পিয়ারসাল ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে বুকে ব্যথা ও মাথাব্যথা নিয়ে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে যান। তিনি মনে করেছিলেন তার রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু তা নয়।
একজন ডাক্তার তাকে বলেছিলেন, “এটি সম্ভবত ছুটির দিনের চাপ ছিল। বাড়িতে যান ও কয়েকদিন চিকিৎসকদের ফলোআপে থাকুন ঠিক হয়ে যাবে।”
আরও পড়ুন: যে ৫ ভুলে বেড়ে যায় বয়স
অন্যান্য দিনে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে মানসিক চাপ কম থাকে। কিন্তু ছুটির দিনে কাজ করায় বা কাজ কম থাকায় ব্রেন সেটি নিতে পারেনি বলে চিকিৎসকরা একে হলিডে স্ট্রেস বলে চিহ্নিত করেন।
পিয়ারসাল সিএনএনকে বলেন, ডাক্তারের কথা মতো বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। তার একটি স্ট্রোক হয়েছিল, এই কারণে শরীরের বাম দিকটি মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল। সুস্থ্য হতে কয়েক মাস লেগেছিল।
তত্ত্বাবধায়ক হতে হবে নিজেকেই
প্রায় ২০ বছর ধরে পিয়ারসাল স্ট্রোকের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের স্ট্রোকের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন।
সচেতনা বাড়ানোর সময়গুলোতে তিনি ক্যাপিটল হিলে কথা বলেছেন, হোয়াইট হাউসে মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন এবং নারী কার্ডিওলজিস্টদের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের উদ্দেশ্যে এই নারী বলেন “আপনাকে আপনার নিজের তত্ত্বাবধায়ক হতে হবে। কারণ কালো হওয়ার কারণে আপনি ছাড় পাবেন না। আপনি বৈষম্যের শিকার হতেই হবে। আপনাকে শ্বেতাঙ্গ পুরুষের চেয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে” ।
রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও শর্করার মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষার তাগিদ
স্ট্রোক সচেতন এই নারী বলেন “কৃষ্ণাঙ্গরা প্রাকৃতিকভাবেই শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় শক্তিশালী। তাই সঠিক জ্ঞান ও শিক্ষার মাধ্যমে এই স্ট্রোকজনিত বিষয়টির মোড় ঘুরিয়ে দেয়া সম্ভব।”বলেও জানান তিনি।
সবাইকে বিশেষত স্ট্রোকের ঝুঁকিতে থাকা কালো আমেরিকানদের রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন।
আরও পড়ুন: নারীদের সুস্থতার ৮ বিষয়
তিনি বলেন, “আমি এই বিষয়ে এতো উদ্বিগ্ন কারণ, আমি চাই না আমার যা হয়েছে তা অন্য কোনোও কৃষ্ণাঙ্গ নারীর হোক। আমি এটির অবসান হোক চাই।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে জাতিগত বৈষম্য বা বর্ণবাদ বৈষম্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি গুরুতর সমস্যা রয়ে গেছে। কালো ও সাদা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্ট্রোকের ঘটনাগুলোর মধ্যে “স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় পদ্ধতিগত বর্ণবাদ” সবচেয়ে বড় কারণ বলে উল্লেখ করেছেন গবেষকরা।
স্ট্র্রোক এর কারণ
অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ
ধূমপান, তামাক পাতা, জর্দা, মাদক সেবন
ডায়াবেটিস, রক্তে অতিমাত্রায় চর্বি, হাইপার টেনশন, হৃদরোগ
অলস জীবনযাপন, স্থুলতা অথবা অতিরিক্ত মোটা হওয়া, মাত্রাতিরিক্ত কোমল পানীয় পান
অ্যাসপিরিন, ক্লপিডগ্রেল প্রভৃতি ওষুধের ব্যবহারে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ
ঘুমে নাক ডাকা, শ্বাসকষ্ট ও কিডনি রোগ
যে কোনো প্রকার প্রদাহ বা ইনফেকশন, জন্মগতভাবে মস্তিষ্কে সরু রক্তনালী থাকলে
বংশানুক্রমে রক্তের রোগ, আগের স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও দূরবর্তী রক্তনালী বন্ধ থাকলে
আরও পড়ুন: হৃদরোগ এর ঝুঁকি এড়াতে যেসব খাবার বাদ দিত হবে
স্ট্রোক এর লক্ষণসমূহ
দেহের কোথাও বা একাংশ অবশ ভাব লাগা কিংবা দুর্বল অনুভব হওয়া। হঠাৎ মুখ, হাত ও পা এক পাশ অবশ হয়ে যাওয়া
হঠাৎ কথা বলতে ও বুঝতে সমস্যা হওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, অস্পষ্ট হওয়া ও একেবারে কথা বলতে বা বুঝতে না পারা।
মুখ বেঁকে যাওয়া, হাসার সময় মুখ অন্য পাশে চলে যাওয়া। অনেক সময় মুখের মাংস পেশি অবশ হয়ে যায়, লালা ঝরা
এক চোখ বা দুই চোখেই ঝাপসা দেখা বা না দেখা
আচমকা অতিরিক্ত মাথা ব্যাথা, মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ঘোরা, দৃষ্টি ঘোলা লাগা, হঠাৎ করে হতবম্ব হয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া
পায়ে দুর্বলতা অনুভব করা, হঠাৎ সোজা হয়ে বসা ও দাঁড়াতে সমস্যা হওয়া, মাথা ঘোরানো ও হাঁটার সমস্যা হওয়া
অজ্ঞান হওয়া, খিঁচুনি, তীব্র মাথাব্যথা ও বমি করা
তথ্যসূত্র: সিএনএন, দ্য ডেইলি স্টার ইউএস টুডে ও মেডিকেল নিউজ টুডে