দেশ স্বাধীনের আগে থেকেই রাজশাগী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের চাষাবাদ হয়। কিন্তু আগে তেমন কোনো পরিচর্যা হতো না। বিভিন্ন প্রজাতির আম থাকলেও বাণিজ্যিকীকরণের কোনো কার্যক্রম ছিল না।
তবে যুগের পরিবর্তন ও ভোক্তাদের চাহিদা বাড়ায় বাজার সম্প্রসারণ হয়েছে। আগে অনেক গুটিজাতের আম দেখা গেছে, যা এখন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর চিন্তা ভাবনা আসল, ভালো জাতের সম্প্রসারণের।
ব্যাপকহারে লাগানো হলো ভালো ভালো জাতের আমের। এতে এক বছর আম দেয় আরেক বছর গ্যাপ দেয়। এমন হতে হতে বাজারের ভোক্তা চাহিদা ও চাষিদের লাভের বিষয়টি বিবেচনায় বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার শুরু হলো।
একটি গাছ থেকে প্রতিবছর আম উৎপাদন করতে হবে, বর্তমানে এমন অর্থনৈতিক চিন্তার বিকাশ হয়েছে। পাটের মতো আমকেও অর্থনৈতিক ফসল হিসেবে গণ্য করতে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে।
এ লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমের উচ্চ ফলনশীল জাত আমদানি করা হয়েছে। এরপরে বর্তমানে সারাবছর কিভাবে নিরাপদ আম পাওয়া যায় তার চর্চা চলছে।
রাজশাহীর আম, বিশ্বব্যাপী যার নাম। স্বাদে-গন্ধে এ অঞ্চলের আম এক কথায় অতুলনীয়। কিন্তু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমের আবাদ হলেও রাজশাহীর আমে এতো স্বাদ কেন? রাজশাহীর আম নিয়ে এত মাতামাতি কেন? এমন প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
জানা গেছে, আমের স্বাদ হয় জাত অনুসারে। তবে আমের স্বাদে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে মাটি। একেক এলাকার মাটি একেক স্বাদের আমের জন্ম দেয়।
ধরা যাক, একই জাতের ২টি আমের চারা একটি রংপুরে, আরেকটি সিলেটে রোপন করা হলো। যখন গাছ থেকে ফলন আসবে, তখন দুইটি গাছের আমের স্বাদে বিরাট পার্থক্য দেখা যায়। এর কারণ মাটি। আমের জন্য রাজশাহীর মাটিই সেরা।
এছাড়া রাজশাহীর আবহাওয়া বিশেষ করে তাপমাত্রা অন্যতম কারণ। আমের মুকুল গঠনের সময় কিছুদিন ধরে আবহাওয়ার একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বিরাজ করলে বিশেষ কুড়ি ফুলে রুপান্তর হয়। নতুবা ওটা নতুন পাতায় রূপান্তর হয়।
প্রত্যেক বছরই ওই সময়ে রাজশাহী অঞ্চলের তাপমাত্রা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আমের জন্য অনুকূলে থাকে। ফলে গাছে বেশি মুকুল আসে। তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আম উৎপাদন এলাকা রাজশাহী অঞ্চল।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর আম সুমিষ্ট হয় এটা সকলের জানা বিষয়। মাটির পাশাপাশি জেনেটিক কারণও অন্যতম। এর প্রধান উপাদান বলা চলে এটাই।
এছাড়া, সূর্যের আলো সরাসরি আমে আসার পর আমে সুক্রোজ নামের একটি উপাদান তৈরি হয়। আমরা যে চিনি খাই, তাকেই সুক্রোজ বলে, যার কারণে আম অত্যান্ত সুমিষ্ট হয়।
আবার আম পাঁকার সময় যদি কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হয় বা আকাশ মেঘলা থাকে, তাহলে আমে মিষ্টতার পরিবর্তে টক ভাব থেকে যায় বলে জানিয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ফল গবেষকরা।
বলে রাখা ভালো, দেশে প্রায় ১ হাজার জাতের আম চিহ্নিত করেছেন ফল বিশেষজ্ঞরা। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় এখনো আমের অনেক জাতবৈচিত্র্য দেখা যায়, সেসব আমের স্বাদে-গন্ধে সবার সেরা।
স্থানীয় সেসব জাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ক্ষীরভোগ, মোহনভোগ, রাজভোগ, রানিভোগ, রানিপসন্দ, সিন্দুরা, সুবর্ণরেখা, কুয়াপাহাড়ি, নাক ফজলি, ফজলি, চিনি ফজলি, সুরমাই ফজলি, চিনিমিছরি, জগমোহিনী আম।
এছাড়া রাখালভোগ, রাঙাগুড়ি, গোবিন্দভোগ, তোতাপুরী, মিছরিকান্ত, জালিবান্ধা, বোম্বাই, ভুতো বোম্বাই, পাহাড়িয়া, গোলাপখাস, কাকাতুয়া, দাদভোগ, চম্পা, সূর্যপুরী, কাঁচামিঠা, কলামোচা, শীতলপাটি, লক্ষ্মণভোগও আমেরও জড়ি মেলা ভার।
এর বাইরে গোলাপবাস, কিষানভোগ, বান্দিগুড়ি, রাংগোয়াই, আশ্বিনা, ভাদুড়িগুটি, বনখাসা, বউ ফুসলানি, ক্ষীরমন, দুধসর, রংভিলা, পারিজা, আনোয়ারা, দিলশাদ, আম্রপালি, মল্লিকা, বেগমবাহার, পূজারীভোগ খেতে খুবই সুস্বাদু।
তাছাড়া পলকপুরী, রাজলক্ষ্মী, দুধকুমারী, শ্যামলতা, খাট্টাশে, জাওনা, দমমিছরি, মিছরিমালা, মিছরিবসন্ত, মেসোভোলানি, আনোয়ারা, পলকপুরী, ফুনিয়া, রানিপসন্দ আমও অনেকের পছন্দ।
গোলাপবাস, বাতাসাভোগ, ইটাকালি, গোল্লাছুট, পোল্লাদাগী, মোহনবাঁশি, পরানভোগ, বিড়া, ভারতী, বাদশাহপসন্দ, বেগমপসন্দ, রাজাপসন্দ, বনখাসা, বাগানপল্লি, কালিগুটি, পাকচারা, কালিয়াভোগ, কোহিতুর, কালিগুলি, হাঁড়িভাঙা ও হিম সাগর আম বেশ জনপ্রিয়।
এর পাশাপাশি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলের জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে আমের বহু আধুনিক ও উন্নত জাত উদ্ভাবিত হয়েছে।