রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু নিয়ে অনেক কথা জানা যায়। মৃত্যু নামক যন্ত্রণাটি কবির জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগেই থাকতো। কখনো পানিতে পড়ে মৃত্যু আশঙ্কা, কখনো জ্যোতিষীর দেয়া অকাল মৃত্যুর ভবিষ্যৎ বাণী, কখনো পরিবার-পরিজন প্রিয় মানুষদের ‘ওপাড়ে’ চলে যাওয়ার মুখোমুখি, কখনো বা কষ্ট মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যার চিন্তা রবি কবির জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর সেই ঘটনাগুলোই এখানে তুলে ধরা হলো-
১. পানিতে ডুবে মৃত্যুর আশঙ্কা
বোটের পাল তুলে আসছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। হঠাৎ মাস্তুল আটকে গেল গোরাই সেতুর নিচে। নদীতে প্রবল স্রোতধারা নৌকাকে ধাক্কা মারছিল। অপরদিকে সেতুতে আটকানো মাস্তুল টেনে ধরে রেখেছে তাকে। মাস্তুল হেলতে শুরু করেছে। কবি পড়ে গেলেন পানিতে। ভাগ্য ভালো দূর থেকে এক খেয়া নৌকা এসে উদ্ধার করেছিল রবিকে।
২. গণকের অকালমৃত্যুর রায়
এলাকার প্রধান গণকের সাথে দেখা করতে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। গণক রবি ঠাকুরের ভবিষৎবাণী শোনালেন, নিজের জীবনে মোটে সঞ্চয়ী হতে পারবে না। স্ত্রী বেশ ভালো, যাদের উপকার করেছেন তারাই তাঁর ক্ষতি করবে। আয়ু বড়জোর ৬০ বা ৬২ বছর হবে। কোনোভাবে তা কাটিয়ে দিতে পারলেও জীবন কিছুতেই পেরোবে না ৭০ এর গণ্ডি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু তখনো হয়নি।
স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানালেন এসব কথা। চিঠি লেখার ১১ বছরের মাথায় নভেম্বর মাসে মারা গেলেন স্ত্রী মৃণালিনী। দাম্পতের মাত্র ১৮ বছর ১১ মাস ১৪ দিনের মাথায় সংসার জীবনের ইতি ঘটে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ২৯ বছর।
৩, মায়ের মৃত্যু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট বয়সেই তার ভাই বুধেন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করে। কবি এতোই ছোট ছিলেন যে সেই মৃত্যুস্মৃতি তার মনে দাগই কাটেনি।
রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন মাত্র ১৪। একদিন গভীর রাতে বাড়ির পুরনো এক দাসীর সর্বনাশা চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। তিন তলার ঘরে মা সারদাদেবী তখন প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন।
বড় ভাই জ্যোতিন্দ্রনাথের স্ত্রী, রবীন্দ্রনাথের নতুন ভাবী কাদম্বরী, বিদ্যুৎ গতিতে সরিয়ে নিয়ে গেলেন সেই দাসীকে। এতো রাতে টিমটিমে প্রদ্বীপের আলোয় ঘুম চোখে, রবীন্দ্রনাথ কিছুই বুঝলেন না, শুধু বুকটা যেন হঠাৎ একটু দমে গেল তার। পরদিন শুনলেন মায়ের মৃত্যু সংবাদ।
৪. অভিমানী কাদম্বরীর না ফেরা
১৮৮৪ সাল। চারপাশের গাছপালা, মাটি জল, চন্দ্র সূর্য, গ্রহ তারা সব যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু তাদের থেকেও সত্যি হয়ে দেহ-প্রাণ-হৃদয়-মনের হাজার রকম ছোঁয়ায় যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভুবন জুড়ে, সেই নতুন ভাবী কাদম্বরী অভিমানে আফিম খেয়ে মারা গেলেন ঠাকুরবাড়ির এক বিমর্ষ, করুণ ঘরে।
এতো কাছের, এতো হাসি খেলার সাথী এক নিমেষে স্বপ্নের মতো মিলিয়েই যেন গেলেন না শুধু, রবীন্দ্রনাথের জন্য রেখে গেলেন নিকষ কালো এক-জীবন অন্ধকার। এই অন্ধকারই তারপর যেন তৈরি করে দিলো সর্বকালের সেরা এক কবিকে।
আড়ালে একটা চারাগাছকে রাখলে যেমন সে আলোর খোঁজে মাথা তোলে, কাদম্বরীর না-থাকার অন্ধকারের বেড়া ঠেলে রবীন্দ্রনাথ তেমনই যেন খুঁজে বেড়ালেন এক আলোর পথ।
৫. মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর আকাঙ্খা
কাদম্বরী মারা যাওয়ার কিছুদিন পর ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যার নাম দিয়েছিলেন ‘আত্মা’। বোঝাই গেল, নাম না করেও কাদম্বরীর মৃত্যু নিয়েই নিজের মতামত লিখেছেন সেখানে।
কবি লিখলেন, ‘যে-আত্মবিসর্জন করতে পারে, আত্মার উপর শ্রেষ্ঠ অধিকার শুধু তারই জন্মাতে পারে।’’ ‘আত্মা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেন ইঙ্গিত দিলেন, কাদম্বরীর মারা যাওয়া আসলে এক জরুরি ‘আত্মবিসর্জন।
আত্মহননকে যদি ‘আত্মবিসর্জন’ বলে ধরে নেওয়া যায়, তবে তেমন একটি ইচ্ছা জীবনে অন্তত একবার কিন্তু তাড়া করেছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও। মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর গভীর আকাঙ্ক্ষা একবার গ্রাস করেছিল কবিকে।
ইউনানি চিকিৎসকের ওষুধ খেয়ে রবীন্দ্রনাথের শারীরিক সমস্যা দূর হলেও কিছু মানসিক উপসর্গ দেখা দিয়েছে। ‘মেটিরিয়া মেডিকা’ পড়ে নিজের সেই সব উপসর্গ চিহ্নিত করলেন রবীন্দ্রনাথ: অবসাদ, মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা, কান্নার তাগিদ, হতাশা, আত্মহত্যার প্রবণতা, আক্রোশ ইত্যাদি।
সেই পরিস্থিতিতে রবি ঠাকুর রথীকে লিখলেন, ‘দিন রাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে। মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে না। আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ…।’
কবি প্রায় একই কথা লিখলেন বন্ধু সিএফ অ্যান্ড্রুজকে। কবি লিখলেন, ‘I Feel That I Am on the Brink of a Breakdown’.
৬. অপঘাতে মেয়ের মৃত্যু কামনা
মৃত্যুর আগে যেমন কখনো চেয়েছিলেন নিজের অকালমৃত্যু। তেমনি অসম্ভব কষ্ট পেয়ে, সংসারের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিতে, চেয়েছিলেন নিজের মেয়ের অপঘাতে মৃত্যু। অপঘাতে মৃত্যুকে নিজে খুবই ভয় পেতেন রবীন্দ্রনাথ।
ছোট মেয়ে মীরার সঙ্গে ‘না ভেবে না বুঝে’ নগেন্দ্রনাথের তখন বিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। খেয়াল করেছেন, নগেনের ‘দুর্দ্দাম বর্ব্বরতা’-য় আতঙ্কগ্রস্ত মীরা। পারছে না তার স্বামীকে ভালোবাসতে। বাবা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন, তার চাপিয়ে দেওয়া সম্পর্কের জেরে ছারখার হয়ে গেল মেয়ের জীবন।
এমনই এক শোচনীয় উপলব্ধির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘বিয়ের রাত্রে মীরা যখন নাবার ঘরে ঢুকছিল তখন একটা গোখরো সাপ ফস করে ফণা ধরে উঠেছিল— আজ আমার মনে হয় সে সাপ যদি তখনই ওকে কাটত তাহলে ও পরিত্রাণ পেত।’
৭.রবির অস্ত যাওয়া
৭৬ বছরে বড় অসুখে পড়লেন রবি কবি। এরিসিপেলেস তাঁকে অজ্ঞান করে রাখল টানা ৫০ ঘণ্টা। খবর পেয়ে কলকাতা থেকে ছুটে এলেন চিকিৎসক।
সত্যজিৎ রায় তখন শান্তি নিকেতনে। উপস্থিত এক বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথকে মনে করিয়ে দিলেন সামনে কবির ৮০ বছরের জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ, এবার আশি, আর তার মানেই আসি।’
অসুস্থ কবিকে শান্তি নিকেতন থেকে নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতায়। যাওয়ার পূর্বে আশ্রমের ছোট বড় সবাইকে দেখতে চাইলেন কবি। গাড়িতে শুইয়ে তাঁকে ঘোরানো হলো পুরো আশ্রম। তখন নতুন আলোর জন্য চার দিকে বসানো হচ্ছিল ল্যাম্পপোস্ট। তা দেখে বললেন, ‘এখন বুঝি পুরনো আলো গিয়ে নতুন আলো আসবে?’
আশ্রমের ডাক্তার শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে ইশারায় কাছে ডেকে নিলেন কবি। তার দুইটি হাত নিজের হাতে ধরে বললেন, ‘ডাক্তার, আমার আশ্রম রইল আর আশ্রমবাসীরা রইলেন, তাঁদের তুমি দেখো।’ রবির চোখে তখন পানি। কাঁদছেন শচীন্দ্রনাথও।
কলকাতায় কবির অপারেশন। ভয় পাচ্ছিলেন ব্যথার কথা ভেবে। তার মধ্যেই মুখে মুখে বললেন, নতুন দুইটি কবিতা। টুকে রাখলেন উপস্থিত সেবিকারা। আদরের বৌমা প্রতিমার জন্য সেভাবেই মুখে মুখে বলে লেখালেন একটা চিঠি।
কাঁপাকাঁপা হাতের লেখায় খুবই কষ্টে শুধু নিজে হাতে সই করলেন। এটাই তার শেষ লেখা। ৭ আগস্ট ১৯৪১ সাল। বেলা ১২টা ১০, বিদায় নিলেন ভুবনজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এবার কোনো আশঙ্কা সত্যি হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু