গত ২৬ আগস্ট ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে ১৭শ শতকের শাসক মহারাজ শিবাজী’র বিশাল একটি ভাস্কর্য ভেঙে পড়ে যায়। ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক বিতর্কে তোলপাড় গোটা মহারাষ্ট্র রাজ্য।
এর পারদ গিয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘাড়ে। নড়েচড়ে বসেছে ভারত সরকার। প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের এমন ঘটনা বিশ্ব গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে ঠাঁই পেয়েছে।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা
ঘটনার চারদিন পর ৩০ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ ঘটনায় ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি গত বছরের ৪ ডিসেম্বর ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেছিলেন।
ক্ষমা চেয়ে মোদি বলেন, “আমি তাদের কাছে ক্ষমা চাই যারা ছত্রপতি শিবাজী মহারাজকে তাদের দেবতা হিসেবে সম্মান করেন। আমি জানি তাদের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। তাদের কাছে আমি মাথা নত করে ক্ষমা চাইছি। আমাদের কাছে আমাদের দেবতার চেয়ে বড় কিছুই নয়।”
নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি মহারাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দল। শিব সেনা ও ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি-এনসিপ ‘র বিভক্ত অংশের সাথে মিলে বিজেপি একটি জোটের মাধ্যমে মহারাষ্ট্রের রাজ্য সরকার পরিচালনা করছে।
মুম্বাইয়ে সরব বিরোধীরা
ছত্রপতি শিবাজীর ভাস্কর্য ভেঙে পড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্য। এ ঘটনার প্রতিবাদে পথে নেমেছে বিরোধী জোট ‘মহা বিকাশ আঘাড়ী’।
গত ১ সেপ্টেম্বর মুম্বাইয়ের রাজপথে জুতা মারোসহ নানান কর্মসূচি পালন করেন বিরোধীরা। এতে যোগ দেন বিরোধী নেতা শরদ পাওয়ার, উদ্ধব ঠাকরে ও নানা পাতোলেসহ জোটের বহু নেতাকর্মী।
প্রতীকী জুতা নিয়ে ফোর্ট এলাকার হুতাত্মা চক থেকে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা। সাধারণ মানুষকে ‘জুতা মারো’কর্মসূচিতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান বিরোধী জোটের নেতারা। এই কর্মসূচির অর্থ দোষীদের জুতা দিয়ে আঘাত করা।
বন্ধ করে দেয়া হয় গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া
যেসব স্থানে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয় সেসব এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মূলত অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতেই বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ মোতায়েন করে একনাথ শিন্ডের সরকার। এছাড়া সাধারণ পর্যটকদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় ভারতের দর্শনীয় স্থান গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া।
চাপে ক্ষমতাসীন জোটের শরীকরা
ভাস্কর্য ভেঙে পড়ার ঘটনা রাজ্যের ক্ষমতাসীন জোটকে বেকায়দায় ফেলেছে। বিরোধী দলগুলোকে এই ইস্যুটি সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী রসদ প্রদান করেছে। ভাস্কর্য ভেঙে পড়ার ঘটনায় বিরোধীরা “নীরব প্রতিবাদ” করেছেন।
একই সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি বাণীও উচ্চারণ করেছেন। বিরোধী দলের নেতারা মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্দের পদত্যাগ দাবি করে ভাস্কর্যটির নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেন।
বিরোধী নেতা শরদ পাওয়ার প্রতিবাদ সমাবেশে বলেন, “রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অনেক শিবাজী ভাস্কর্য এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু শুধু নতুনভাবে স্থাপন করা ভাস্কর্যটি ধসে পড়েছে। ভাস্কর্যটি স্থাপন করার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি করা হয়েছে। এটি ছত্রপতি মহারাজের প্রতি অপমান বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
প্রতিবাদ পাল্টা প্রতিবাদের ডাক
বিরোধী জোট রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদ আয়োজন করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি পাল্টা প্রতিবাদ করেছে। এই ইস্যুটি বিরোধীরা রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছে বিজেপি। ক্ষমতাসীন বিজেপি এই কর্মসূচির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং এর মোকাবিলায় পাল্টা কর্মসূচির ডাক দিয়েছে।
অভিযোগ অস্বীকার মুখ্যমন্ত্রীর
বিরোধীদের সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্দে। তিনি বলেছেন, ভাস্কর্যটি উপকূলীয় শহরে প্রবল বাতাস আর বৃষ্টির কারণে ভেঙে পড়েছে। পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট এটি নির্মাণ করেছে।
সংস্থাটির প্রধানকে ইতোমধ্যে ভাস্কর্যটির নাট-বল্টুতে জং ধরার কথা জানানো হয়েছে। ভাস্কর্যটি নির্মাণের দায়িত্বে ভারতীয় নৌবাহিনী ছিল। এর নির্মাণের সঙ্গে জড়িত সবাইকেই শোকজ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
জনসমক্ষে রাজ্য সভাপতির ক্ষমা প্রার্থনা:
ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মহারাষ্ট্র রাজ্যের সভাপতি আশীষ শেলারও ভাস্কর্য ইস্যুতে জনসমক্ষে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ভুল সংশোধন করা হবে, দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে। প্রকল্পের কাঠামোগত পরামর্শদাতাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং ভাস্করকে খোঁজা হচ্ছে।
কে এই ছত্রপতি শিবাজী:
ছত্রপতি শিবাজী মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সাহসী রাজা ও নায়ক। মহারাষ্ট্রসহ ভারতের অন্য রাজ্যে তাকে গুরুত্বপূর্ণ একজন হিন্দু আইকন হিসেবে সম্মান করা হয়। শিবাজীকে ১৬৭৪ সালে রাজকোট দুর্গে ছত্রপতি খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল। সেখানেই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষা ছত্রপতির অর্থ রাজা।
তিনি পশ্চিম, কেন্দ্রীয় ও দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশ নিয়ে মারাঠা রাজ্য শাসন করেছিলেন। তাকে একজন দূরদর্শী নেতা হিসেবে দেখা হয়। তৎকালিন শাসকদের শক্তির সাথে সফলভাবে জোট তৈরির পাশাপাশি সামরিকভাবে প্রতিরোধ করেছেন শিবাজী।
শিবাজী বর্তমানে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র। কোনো রাজনৈতিক দল তাকে অবজ্ঞা করতে বা অপমানের অভিযোগ থেকে বাঁচতে পারে না। শিবাজীর জাতের মারাঠারা রাজ্যের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। রাজ্য গঠনের পর ২০ জন মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ১২ জনই মারাঠা ছিলেন।
ভাস্কর্যটির নির্মাণ ব্যয়:
আট মাস আগে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর নৌবাহিনী দিবসে মহা ধুমধাম করে মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছত্রপতি শিবাজীর ভাস্কর্য উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সামুদ্রিক প্রতিরক্ষায় শিবাজীর যে অবদান ছিল, তার প্রতি সম্মান জানাতেই তার নামে ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়। ৩৫ ফুট বা ১০.৬ মিটার উঁচু ভাস্কর্যটি ২৬ আগস্ট সিন্দুদুর্গ জেলায় ভারী বর্ষণের কারণে ভেঙে পড়ে। এর নির্মাণ খরচ ছিল ২৩.৬ মিলিয়ন রুপি। উদ্বোধনের এতো কম সময়ের মধ্যে ভাস্কর্যটি ভেঙে পড়ায় ভারতজুড়ে তীব্র সমালোচনা চলছে।