বিশ্বের সবচেয়ে বড় হাতে বোনা কার্পেট এই মসজিদে

ধর্মীয় উপাসনালয়ও যে দর্শনীয় স্থান হতে পারে তার নজির স্থাপন করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।

দেশটির রাজধানী আবুধাবীতে নির্মিত শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ দেখতে পর্যটকদের উপচে পড়া ভীড় চোখে পড়ার মতো।

সংযুক্ত আরব আমিরাত গীনেজ বুকে স্থান করে নিয়েছে দর্শনীয় স্থাপনার জন্য। ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকেও পর্যটকদের ঢল নামে এই নান্দনিক মসজিদটি দেখতে।

স্ফটিক সচ্ছ লাখ লাখ পাথরের তৈরি পৃথিবীর বৃহত্তম ঝাড়বাতি এবং মানুষের তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কারপেট রয়েছে এখানে।

শুধুমাত্র ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসেই প্রায় চল্লিশ লাখ দর্শনার্থী মনোমুগদ্ধ এই স্থাপনাটি দেখতে এসেছিলেন। এই ভিডিওতে আমরা আজকে দেখাবো শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ

মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে আমিরাতের প্রয়াত রাষ্ট্র প্রধান শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের নামানুসারে। মসজিদটি আমিরাতের সবচেয়ে বড় ও পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম সুন্দর মসজিদ।

৩৮ টি বিখ্যাত ঠিকাদারি কোম্পানির ৩ হাজার দক্ষ কর্মী বাহিনী এ মসজিদ নির্মাণ করেন। সে সময়ে ইতালি, জার্মানি, মরক্কো, পাকিস্তান, ভারত, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরান, চীন, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, গ্রিস ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক দেশের উপাদানে নির্মিত হয় বিশ্ববিখ্যাত এই মসজিদ।

শেখ জায়েদ মসজিদের নকশায় পাকিস্তান, ভারত ও মরক্কের বিভিন্ন স্থাপনার নকশা অনুসরণ করা হয়েছে। এ মসজিদটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৫৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।

স্থাপত্যশিল্পের জন্যও এটি একটি পাঠশালা। নানা দেশের স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষার্থীরা এ মসজিদে শিখতে আসেন। চার কোণে চারটি মিনারে পুষ্পশোভিত ডিজাইন রয়েছে। যার উচ্চতা ৩৫১ ফুট বা প্রায় ১০৭ মিটার।

এছাড়াও মার্বেল পাথর, সোনা, মূল্যবান পাথর, স্ফটিক ও মৃৎশিল্পের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে আরবের ২০০ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শিল্পচর্চার নমুনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোহাম্মদ মান্দি আল তামামি, সিরিয়ার ফারুক হাদ্দাদ ও জর্দানের মোহাম্মদ আলাম এর ক্যালিওগ্রাফি ও ডিজাইন চোখে পরে মসজিদের সব খানেই।

মসজিদটিতে ছোট-বড় সাত আকারের ৮২টি গম্বুজ। যা নির্মাণ করা হয়েছে সাদা মার্বেল দিয়ে। মসজিদের বৃহত্তম গম্বুজের উচ্চতা ২৭৯ ফুট।

প্রধান উপাসনা কক্ষে ইরানের কার্পেট কোম্পানি তৈরি যা ইরানি শিল্পী আলী খালিদির ডিজাইনে বিশ্বের বৃহত্তম গালিচা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এই গালিচা ৬০ হাজার ৫৭০ বর্গ ফুট এবং এই কার্পেট এর ওজন ৩৫ টন। নিউজিল্যান্ড এবং ইরানের উল থেকে তৈরি করতে প্রায় দুই বছর সময় লেগেছিল।

দিনের বেলায় মসজিদটি চোখে ভাসে সাদা আলোয়। রাতের মায়াবি রূপ যেন পর্যটকদের আরো কাছে টানে। বাহারি রঙের আলোয় ঝিলমিল করে মসজিদের চারপাশ।

স্ফটিক সচ্ছ লাখ লাখ পাথরের তৈরি পৃথিবীর বৃহত্তম ঝাড়বাতিটি এই মসজিদে। জার্মানির তৈরি ঝাড়বাতিটির ব্যাস ৩৩ ফুট, উচ্চতা ৪৯ ফুট দ্বিতীয়, তৃতীয় বৃহত্তম ঝাড়বাতিও এই মসজিদের সৌন্দর্য।

মসজিদটির আঙিনা ১৭ হাজার বর্গমিটার মার্বেল মোজাইকের। এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ আয়তনের মার্বেল মোজাইক।

শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও এই মসজিদের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। আধুনিক ও ইসলামী বইয়ের এক অনন্য সংগ্রহশালা রয়েছে মসজিদ লাইব্রেরীতে।

ইসলামী বিশ্বের বৈচিত্র্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঐতিহ্য ফুটিয়ে তুলতে সংগ্রহ করা হয়েছে আরবি, ইংরেজি, ফরাসি, ইতালীয়, স্পেনীয়, জার্মান ও কোরীয়সহ বিভিন্ন ভাষার বই।

মসজিদটি দেখতে নানা ধর্মের নারী পুরুষের সমাগম প্রতিদিন চোখে পড়ে। অমুসলিম নারীদের জন্যও বোরকা পরিয়ে মসজিদে ঢুকানো হয়। রয়েছে কড়া নিরাপক্তা আর পর্যটকদের জন্য মসজিদের প্রবেশপথে ফ্রি গাড়ি সার্ভিস।

প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ আবুধাবিতে যান এই মসজিদটি দেখতে। এতো মানুষ মসজিদটি দেখতে ভিড় জমালেও, শেখ জায়েদ মসজিদে রয়েছে এক ধরনের প্রশান্তি আর অদ্ভুত নীরবতা।

শুধুমাত্র ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসেই প্রায় চল্লিশ লাখ দর্শনার্থী এটি দেখে গেছেন। ২০১৮ সালে ভ্রমণ বিষয়ক ওয়েবসাইট ট্রিপ এডভাইজারের করা তালিকায় তৃতীয় জনপ্রিয় স্থাপনা হিসাবে উঠে আসে মসজিদটির নাম।

আবুধাবির জাঁকজমকপূর্ণ এই মসজিদটি তৈরির কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে ১২ বছর। বর্তমান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এই মসজিদটির আয়তন ২২ হাজার ৪১২ বর্গমিটার। যা প্রায় চারটি ফুটবল মাঠের সমান। উদ্বোধনের পর থেকেই উন্মুক্ত করা হয় পর্যটকদের জন্য।

একসঙ্গে এই মসজিদে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ নামাজ পরতে পারেন। এছাড়াও জুম্মা ও ঈদে মোট দুই লাখ মুসল্লি নামাজ আদায় করেন।

বৃহত্তম হাতে বোনা কার্পেট, ঝাড়বাতি ও বৃহত্তম গম্বুজের গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে রয়েছে এই মসজিদের নামে। ৭টি বড় গম্বুজ হলেও ভিন্ন ধরনের ৪০টি গম্বুজ আছে এই দৃষ্টিনন্দন মসজিদে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রথম রাষ্ট্রপতি প্রয়াত শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানই এই মসজিদ করার পরিকল্পনা করেছিলেন।

এই মসজিদ নির্মাণের স্থাপত্য বিষয়ক নির্দেশনা তারই ছিল। তিনি তার সমাধি এই মসজিদে করার ইচ্ছা পোষণ করেন। ২০০৪ সালে তিনি মারা গেলে মসজিদ চত্বরে তাকে সমাহিত করা হয়।

মসজিদটি দেখার জন্য কোনো টিকিট কাটতে হয় না। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য এটি খোলা থাকে। রাত ৯টার পরে আর কোনো দর্শনার্থী প্রবেশ করতে পারেন না।

তবে শুধু শুক্রবার জুমার নামাজের দিকে খেয়াল রেখে এদিন দর্শনার্থীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয় বিকাল সাড়ে চারটা থেকে। কোনো প্রকার ফি ছাড়াই একজন গাইড দর্শনাকে ঘুড়িয়ে দেখায় এই মসজিদটি।

বিকেল পাঁচটা থেকে শুরু হয় আলোকসজ্জা। সূর্যাস্তের পর এই মসজিদটির আলোকসজ্জা যে কাউকে চোখ জুড়িয়ে দেবে। দিনের বেলায় দেখার থেকে সন্ধ্যার পর দেখা মসজিদটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হবে।

একটি মুসলিম স্থাপত্য ও নামাজের জায়গা হিসাবে প্রবেশের জন্য অবশ্যই মার্জিত পোশাক পরতে হয়। নারীদের পা, হাত ও মাথা ঢেকে রেখে ও পুরুষদের লম্বা পোশাক পরতে হয়, যা তাদের শরীরকে ঢেকে রাখে।

তবে মসজিদে প্রবেশের আগে বিনামূল্যে ঐতিহ্যবাহী পোশাক (আবায়া) সরবরাহ করা হয়। এর ফলে মসজিদ-উপযুক্ত পোশাক খুঁজে নেওয়ার কোনা ঝামেলা থাকে না।

স্থাপত্যের এই অনন্য নিদর্শন আপনাকে বারবার নিয়ে যেতে চাইবে আবুধাবির শেখ জায়েদ গ্রান্ড মসজিদের আঙিনায়।