আধুনিক সমাজের প্রায় সব শ্রেণীর-পেশার মানুষ চা পান করে থাকে। চায়ের সাথে পরিচয় বা সখ্যতা নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। অফিস-আদালত, বাসা-বাড়িসহ সর্বত্রই এই পানীয়টির সমান জনপ্রিয়তা রয়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চিমের দেশ আমেরিকা পূর্বের দেশ জাপান থেকে শুরু করে উত্তরের নরওয়ে ও দক্ষিণের চিলি সব দেশের মানুষই চা পানে অভ্যস্ত। গোটা বিশ্বেই চায়ের জুড়ি মেলা ভার।
আপনি কি অনুমান করতে পারেন এই পানীয়টি মানব সভ্যতার ইতিহাসের কতো গভীরভাবে প্রোথিত আছে। আর যদি সেটা হয় খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ সাল অর্থাৎ যীশু খ্রিস্টের জন্মেরও আরোও আড়াই হাজার বছর আগে তবে কেমন মনে হবে আপনার?
আপনি যদি চা নিয়ে এমন অনুমান করে থাকেন তবে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর তথ্য বলছে আপনার অনুমান সঠিক। আপনি একজন চা প্রেমীর নামের তালিকায় নাম লেখালেন।
হিস্ট্রি সেন্ট্রালের তথ্য বলছে, মিনোয়ান সভ্যতার সময় থেকে চা পান হয়ে আসছে মানুষের মধ্যে। মানব সভ্যতার প্রাচীনতম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মিনোয়ান সভ্যতা। তবে চা নিয়ে অনেক মিথও শোনা যা।
মার্কিন গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিস্টার রিপোর্ট বলছে, চা যে কেবল দীর্ঘকাল ধরেই মানুষ পান করছে তা নয়। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় জনপ্রিয় পানীয়ও বটে। সংস্থাটির মতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পান করা হয় পানি। প্রথমটি পানি আর এর পরেই রয়েছে চা।
টি ইউএসএ তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে আমেরিকানরা প্রায় ৮৫ বিলিয়ন চা পান করেছিল। আমেরিকার প্রায় ৮০ শতাংশ বাড়িতে চা থাকে। অনেক ভেষজ ঔষধি উপকারিতা পাওয়া যায় বলেই চা এতো জনপ্রিয় আমেরিকানদের মাঝে।
ওয়েবএমডির তথ্য অনুসারে, রুইবোস ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে বলে বিশ্বাস করা হয়, ক্যামোমাইল অনিদ্রায় সহায়তা করতে পারে এবং পেপারমিন্ট মাথাব্যথা প্রশমিত করতে পারে। যারা কফিতে অতিমাত্রায় আসক্ত তাদের জন্যও চা হতে পারে নিখুঁত বিকল্প।
জনপ্রিয় ক্যাফিনেটেড সংস্করণগুলোর মধ্যে রয়েছে সবুজ, কালো ও ওলং চা, যা অনেকে গরম বা বরফের সাথে মিশিয়ে পান করে থাকেন।
টি ইউএসএ-এর তথ্য মতে, আমেরিকানরা এতো পরিমাণ চা চান করে যে দেশটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম চা আমদানিকারক। কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে এতো বিপুল পরিমাণ চা তো আমেরিকায় জন্মায় না তবে এতো চা কোথা থেকে আসে আমেরিকায়?
চা উৎপাদনে এগিয়ে চীন:
আপনি জেনে অবাক হলেও হতে পারেন। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ চা আসে চীন থেকে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য বলছে, ২০২০ সালে চীনই চা উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে। প্রায় ৩ মিলিয়ন টন চা পাতা উৎপাদন করেছে দেশটি। আর এর প্রায় অর্ধেক ১.৪ মিলিয়ন টন চা উৎপাদন করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত।
এরপরে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে যথাক্রমে কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কা। পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে আছে তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া। আর সপ্তম অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম অন্যদিকে জাপান আছে আটে। এছাড়া নবম ও দশম স্থানে আছে যথাক্রমে ইরান ও আর্জেন্টিনা।
মজার ব্যাপার হলো বিশ্বের বৃহত্তম চা সরবারহকারী দেশ চীনে চা সমানভাবে তৈরি করা হয় না। স্ট্যাটিস্টার রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালে চীনের চা উৎপাদনের ৬০ ভাগ ছিল গ্রিন টি।
এদিকে ওয়ার্ল্ড টি নিউজের তথ্য বলছে, আমেরিকার লোকেরা চীনের গ্রিন টির ওপর নির্ভরশীল। চীন আমেরিকায় গ্রিন টি রপ্তানি না করলে আমেরিকানরা গ্রিন টি পান করতে কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে যায়। তারা চীনা গ্রিন টিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।
আমেরিকায় মোট যে চায়ের চাহিদা রয়েছে তার প্রায় অর্ধেকই আসে চীন থেকে। মার্কিনীরা বাড়িতে বা অফিসে বহুমূখী কাজ করার সময় চীনা চায়ে চুমুক দিতে দিতে করতে বেশ জোস পায়। এই কারণেই চীনা চায়ে তারা বেশি আগ্রহী।
ডিস্ট্যান্ট জার্নিস এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চীনারা দেশটিতে চাইনিজ চায়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। সেখানে সুগন্ধযুক্ত চাও উপভোগ করা হয়, তিন চুমুকের মধ্যে খাওয়ার পাশাপাশি সুন্দর চা-পাতা ব্যবহার করা হয় ওই অনুষ্ঠানগুলোতে।
ট্রাভেল চায়না গাইড এর তথ্য অনুসারে, ইউনউ, মাওফেং, লংজিংসহ আরও অনেকগ অঞ্চলের ওপর নির্ভর করে চীনা জাতগুলো আলাদা করা হয়। একেক অঞ্চলে এক এক ধরনের চা তৈরি করেন চীনারা।
চীনের ইতিহাসের শিকড়ে চা:
চীন শুধুমাত্র বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চা উৎপাদনকারী দেশই নয়, চায়ের জন্মস্থানও চীনেই। চায়ের জন্ম দিয়ে অনেক আগে থেকেই নানান ধরনের লোক কথা শোনা যায়। এসব কেউ সঠিক মনে করে আবার অনেক বিশ্বাস করে না। তবে সবচেয়ে আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য মিথটি সম্রাট শেন নাং কে নিয়ে।
কথিত আছে, চীনা কৃষির জনক হিসাবেও পরিচিত সম্রাট শেন নাং একদিন তার রাজপ্রাসাদে একটি গাছের নীচে বসে গরম জল পান করেছিলেন। এই ঘটনাটি ২৭৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ঘটেছিল।
মজার ব্যপার হলো, চীনা ভাষায় ‘শেন নাং’ অর্থ হলো ‘স্বর্গীয় কৃষক’। হাজার বছর আগের এই সম্রাট ছিলেন দারুণ স্বাস্থ্যসচেতন। একবার তিনি ডিক্রী চালু করলেন যে তার প্রজাদের সবাইকে পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে।
তো একদিন বিকেলে রাজকার্যের ক্লান্তি দূর করার জন্য ক্যামেলিয়া গাছের নিচে বসে সম্রাট ফুটানো গরম পানি পান করছিলেন, কোত্থেকে যেন তার গরম পানির পাত্রে এসে পড়লো কয়েকটি অচেনা পাতা। সম্রাট তো অবাক
পাতাগুলো পানি থেকে বের করার আগেই তার নির্যাস মিশে যেতে লাগলো পানির সাথে আর ভোজবাজির মত পাল্টাতে লাগলো পানির রং। বিষয়টি সম্রাটকে ভাবিয়ে তুললো।
কৌতূহলী সম্রাট শেন নাং ভাবলেন এ নির্যাসও একবার পান করে দেখে নেওয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ, নির্যাসমিশ্রিত এ পানি পান করার পর নিজেকে অন্যদিনের চাইতে অনেক বেশি চনমনে লাগলো তার।
ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেলো, ক্লান্তি দূর হলো আর সম্রাটও নতুন স্বাদ পেয়ে মহা খুশি। এরপর অনেক খুঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল পাতাটির উৎস- ‘ক্যামেলিয়া সিনেনসিস’ গাছ। এটি চায়ের বৈজ্ঞানিক নাম। চা আবিষ্কারের নায়ক চীনা সম্রাট ‘শেন নাং’
সেই শুরু থেকে চীনারা করে আসছেন চায়ের পৃষ্টপোষকতা। চীনারা চাকে ‘মহৌষধি’ বা ‘পরশমণি’বলে থাকেন। প্রাচীন চীনারা বলে গেছেন, “চায়ের মত এমন প্রাকৃতিক সুঘ্রাণ আর কিছুতে নেই আর এ কথার সূত্র ধরেই হয়তো আজ চায়ের নির্যাসে তৈরী হয়েছে মোহময় সুগন্ধি।
এদিকে চীনের দ্য স্প্রস ইটস বলছে, ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রথম দিকে চায়ের উল্লেখ রয়েছে চীনা পুরনো অভিধানে। আসলে চা আবিষ্কারের সঠিক বছর নির্ণয় করা কঠিন। কিন্তু চীনই চায়ের উৎস দেশ এই বিষয়ে ইতিহাসবিদরা একমত। তারাই প্রথম চা চাষ করেছিল।
ইউকে টি অ্যান্ড ইনফিউশনস অ্যাসোসিয়েশন এর তথ্য বলছে, ৬১৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া তাং রাজবংশে শাসনামলে চীনের জাতীয় পানীয় হিসাবে চা স্থান পায়। অষ্টম শতাব্দীতে বৌদ্ধ লু ইউ দ্বারা প্রকাশিত “দ্য ক্লাসিক অফ টি”-তে চীনা চা অনুষ্ঠানের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
এনপিআরের তথ্য বলছে, এই নির্দেশিকায় লেখক চা পানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। চা ধীরে ধীরে চুমুক দেওয়াসহ চান পান করার উপর জোর দেন তিনি। এরপর থেকে চীন চায়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।
এরপর এটি প্রতিবেশি জাপানে জনিপ্রয়তা পায়। তারপর ইউরোপের দেশেগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে উঠে চা। ১৬৫৮ সালে ব্রিটেনে “চীনা ড্রিংক’নামে পরিচিতি পায় চা। ইউরোপের অন্যান্য দেশে চাকে থাচা নামে ডাকা হয়।
চা ঐতিহ্যগত চীনা ওষুধ:
পাশ্চাত্য স্বাস্থ্য সুবিধার বাইরেও চা এবং অন্যান্য ভেষজ উপাদানগুলো ঐতিহ্যগত চীনা ওষুধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে চায়ের কদর রয়েছে মূলত এই কারণেই।
ওয়েব এমবির তথ্য মতে, ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধ হল একটি প্রাচীন স্বাস্থ্যসেবা, যা সামগ্রিকভাবে শরীরকে ভারসাম্য ও সুস্থ রাখতে ভূমিকা রাখে। হজম, ত্বকের প্রদাহ, জ্বরসহ আরও অনেক সমস্যা সমাধান করে চা।
শারীরিক নানান জটিলতায় উপকারের জন্য কিছু মৌসুমী চা বেশ কাযকরি। ব্লাক ও ওলং চা শীতকালের জন্য সেরা চা হিসেবে স্বীকৃত। এ জাতীয় চায়ে সুগন্ধ থাকে বলে তা শরীরকে উষ্ণ রাখার পাশাপাশি যথেষ্ট তাপও প্রদান করে থাকে।
আপনার মুখমণ্ডল সতেজ রাখতে কালো, ওলং চা বা বেছে নিচ্ছেন না কেন? এটা বলা নিরাপদ যে আপনি চীনের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলোর মধ্যে একটির স্বাদ নিচ্ছেন।
তথ্যসূত্র: টেস্টিং টেবিল