বিশ্বজুড়ে আলোচিত এক ব্যক্তিত্ব জেসিন্ডা আরডেন। শেষ কর্মদিবস আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি। তবে এর আগেই নিজের প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়ার ঘোষণা দেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডেন। ১১ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে তার আচমকা পদত্যাগের ঘোষণায় অনেকেই হতবাক বনে যান।
প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়া প্রসঙ্গে জেসিন্ডা আরডেন বলেন, ‘‘এমন একটি বিশেষ পদের সাথে অনেক রকম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব জড়িয়ে থাকে। নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আপনি কখন সঠিক ব্যক্তি আর কখন না, তা বোঝার দায়িত্ব আপনারই।’’
পদত্যাগের ঘোষণায় হতবাক বিশ্বনেতারা
আগামী বছর অক্টোবরে নিউজিল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সাথে প্রধান বিরোধী দল ন্যাশনাল পার্টির তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতা হতে পারে বলে বিভিন্ন জনমত জরীপে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। তার আগে জেসিন্ডা আরডেন এর এই ঘোষণা ঘিরে আলোচনা শুরু হয়েছে।
২০১৭ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে নিউজ়িল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন জেসিন্ডা আরডেন। ওই সময় বিশ্বের কনিষ্ঠতম রাষ্ট্রনেতা হিসেবে সবার দৃষ্টি কাড়েন তিনি।
২০২০ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টির বিপুল বিজয়ের পরে দ্বিতীয় বার কিইউ প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত হন জেসিন্ডা আরডেন। এর আগে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ারের দফতরে অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবেও কাজ করেছেন জেসিন্ডা আরডেন।
বিয়ে করা হয়ে উঠেনি
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে নিজের বিয়ের তারিখ বার বার বাতিল করেছিলেন জেসিন্ডা আরডেন। নানা রাজনৈতিক কারণে বিয়ের পরবর্তী তারিখ বের করা হয়ে ওঠেনি তার। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বাও হন জেসিন্ডা আরডেন।
২০১৮ সালে কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর তার বিয়ের তারিখ নিয়ে পানি কম ঘোল হয়নি। ২০১৩ সালে নিজের জীবন সাথী নির্বাচন করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের ভাবি প্রধানমন্ত্রী।
ক্লার্ক গেফোর্ড নামের এক সাংবাদিকের প্রেমে পড়েন জেসিন্ডা আরডেন। তবে কাজের চাপে মনের মানুষকে বিয়ে করার সময় পাননি জেসিন্ডা। তখন তিনি বিরোধী দলের এমপি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
কিশোরী বয়স থেকেই রাজনীতির সাথে পথচলা
জেসিন্ডা আরডনের যখন ১৭ বছরের কিশোরী, তখন থেকে রাজনীতির সাথে পরিচয় ঘটে। ১৯৯৭ সাল থেকে লেবার পার্টির সাথে কাজ করছেন তিনি।
২০০১ সালে অনার্স পাশ করার পরে বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দফতরে কাজ করতে শুরু করেন জেসিন্ডা আরডেন।
২০০৮ সালে প্রথম নিউজিল্যান্ডের হাউস অফ রিপ্রেসেন্টেটিভস-এর সদস্য নির্বাচিত হন জেসিন্ডা। তার ৪ বছর পরে ক্লার্ক গেফোর্ডকে নিজের সাথী হিসাবে বেছে নেন তিনি।
সন্তান কোলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন
এই সময়ে লেবার পার্টির প্রধানের দায়িত্ব পড়ে জেসিন্ডার ওপর। কোলের সন্তানকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদের দায়িত্বের পাশাপাশি দলের দায়িত্বও নিষ্ঠার সাথে পালন করে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রশংসিত হন কনিষ্ঠ এই প্রধানমন্ত্রী।
ক্লার্কে গেফোর্ড এর সাথে সম্পর্ক ছয় বছরের গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়ার পর এক কন্যা সন্তানের জননী হন জেসিন্ডা আরডেন। এর পর তাঁর বিয়ে নিয়ে তোড়জোড় শুরু হলেও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাতে ব্যস্ত থাকায় বিয়ে করার সময় বের করতে পারেনি তিনি।
বার বার বিয়ের তারিখ বাতিল
২০২০ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর সবার ধারণা ছিল এবার ক্লার্ককে বিয়ে করবেন জেসিন্ডা। তবে কোভিড মহামারির কারণে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লে সেবারও বিয়ে পিছিয়ে যায় জেসিন্ডা আরডেন এর।
২০২২ সাল পর্যন্ত দরিদ্র, শিশুদের অপুষ্টি ও করোনা প্রতিরোধে বিশেষ কাজ করেছিল জেসিন্ডা আরডেন নেতৃত্বাধীন সরকার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিয়ে করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন তিনি।
বিয়ের তারিখও নির্ধারণ করেছিলেন জেসিন্ডা। তবে আবার ওমিক্রনের সংক্রমণ শুরু হওয়ায় কড়াকড়ি নিয়ম চালু করে তার সরকার। কোনও জমায়েত করা যাবে না বলে নির্দেশনা জারি করা হয়। তাই জেসিন্ডাও বিয়ের তারিখ বাতিল করে দেন।
আবারও বিশ্বজুড়ে আলোচনায় জেসিন্ডা আরডেন
নিজের মুখে পদত্যাগের ঘোষণা নিয়ে আবারও নতুন করে আলোচনায় আসেন বিশ্বজুড়ে। তবে কি জেসিন্ডা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের দিকে নজর দিচ্ছেন। এমন প্রশ্ন নেট দুনিয়ায় ঘুরপাক খেতে থাকে। তবে এর উত্তরও চলে আসে খুব কম সময়ের মধ্যেই।
এবার ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের পার্টনার ক্লার্ক গেফোর্ড এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডেন।
এ জন্য রাজধানী ওয়েলিংটন থেকে প্রায় ৩১০ কিলোমিটার উত্তরে নর্থ আইল্যান্ডের হকস বে তে আয়োজন করা হয় এক আনুষ্ঠান। সেখানে আমন্ত্রিত কয়েক ডজন অতিথির সামনে ৫ মিনিট বক্তব্য রাখেন আরডেন।
বাবা মায়ের বিয়ে উপভোগ করে কন্যা নেভে
এক দশক ধরে এই যুগল এক সাথে অবস্থান করছেন। এ সময়ে তাদের একটি কন্যা সন্তানও হয়েছে। তার নাম রাখা হয়েছে নেভে। এই যুগলের সন্তানের বয়স ৫ বছর।
বিয়েতে জেসিন্দা আরডেন জুলিয়েটে হোগানের ডিজাইন করা একটি ধবধরে সাদা গাউন পরিধান করেন। হোগান আবার জেসিন্ডা আরডেন এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর জুতা আনা হয় ক্যাওয়াস অ্যান্ড হারমোনির ডিজাইনের মাউন্ট মুঙ্গানাউ থেকে।
কন্যা নেভে বিয়ের অনুষ্ঠানে তার পিতার সাথে হেঁটে আসে। নানী লরেল আরডেন এর বিয়ের পোশাক দিয়ে তৈরি করা একটি পোশাক পরেছিল নেভে।
জেসিন্দা আরডেন এর বয়স এখন ৪৩ বছর। তিনি ৫ বছরে বেশি সময় নিউজিল্যান্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবশেষে তিনি গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দেন পদত্যাগের।
দুই মসজিদে হামলা মোকাবিলা করে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত
নেতৃত্ব দেয়ার ধরনের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন জেসিন্ডা আরডেন। বিশেষ করে ২০১৯ সালে ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে যে ভয়াবহ হামলা হয়, তার প্রেক্ষিতে যে পদক্ষেপ তিনি নেন তার প্রশংসা করা হয় বিশ্বজুড়ে।
অনুপ্রেরণাদায়ী তিন নারী নেতার একজন
করোনা মোকাবিলায় সাফল্য অর্জনের স্বীকৃতস্বরূপ কমনওয়েলথভুক্ত ৫৪টি দেশের সরকার প্রধানদের মধ্যে সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী তিন নারী নেতার একজন নির্বাচিত হয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডেন।
কমনওয়েলথ মহাসচিব পেট্রেসিয়া স্কটল্যান্ড কিউসি আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২১ সামনে রেখে ৪ মার্চ এক বিশেষ ঘোষণায় তিন সরকারপ্রধানকে করোনাকালে ‘অসাধারণ নারী নেতৃত্ব ও গভীর অনুপ্রেরণাদায়ী’ হিসেবে আখ্যা দেন।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডেন ছাড়া কমনওয়েলথের বাকি দুইজন বিস্ময়কর নেতা নির্বাচিত হন বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া আমোর মোটলে ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জেসিন্ডা আরডেনের মতো নেতা দরকার আমেরিকায়
২০১৯ সালে জুমার নামাজ চলাকালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে এক শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীর হাতে সংঘটিত পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববাসীর কাছে মানবতার এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে হাজির হন। হামলার পর তিনি যেভাবে পরিস্থিতি সামলান তাতে নিহতদের স্বজনদের যন্ত্রণা অনেকখানি কমে যায়।
অনেকেই বলছেন, যেকোনো দেশে এমন একজন প্রধানমন্ত্রী থাকা দেশটির জন্য গর্বের বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসও তাকে নিয়ে সম্পাদকীয় ছাপে। ‘জেসিন্ডা আরডেন এর মতো নেতা দরকার আমেরিকার’।
সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে কিভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে ঘৃণা, সহিংসতা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হয় তা নিউজিল্যান্ডে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করল। তবে এই ঘটনার পর যেভাবে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডেন দেশটির প্রকৃত অভিভাবক হিসেবে প্রকাশ্যে আসলেন তাও অন্যদের জন্য অনুকরণীয়।
সেদিনের হত্যাকাণ্ডের পরপরই জেসিন্ডা তার দেশের জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সামরিক ধাঁচের অস্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। এই ধরনের অস্ত্রের কারণে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
কথা মতো তিনি সামরিক ধাঁচের স্বয়ংক্রিয় ও আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সামরিক বাহিনী ছাড়া কারো হাতে এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র দেখলেই তাকে গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনেন।
জেসিন্ডার পরিপক্বতা ও রাষ্ট্রের যোগ্য নেতারই পরিচয় বহন করে বলে নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়। প্রশ্ন রেখে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, নিউজিল্যান্ড একজন জেসিন্ডা পেলে আমেরিকা কেন পাবে না।