টিকেও (TKO) গ্রুপ হোল্ডিংস এর নির্বাহী চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন ডাব্লিউডাব্লিউই এর প্রতিষ্ঠাতা ভিন্স ম্যাকম্যান। ধর্ষণ ও যৌনতার অভিযোগে পদত্যাগ করলেও কোম্পানির স্বার্থেই পদত্যাগ করেছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। ডাব্লিউডাব্লিউই (WWE) ও ইউএফসি(UFC)-এর মূল কোম্পানি হচ্ছে টিকেও (TKO)।
জেনেল গ্রান্টের দাবি অস্বীকার
পদত্যাগের বিষয়ে এক বিবৃতিতে ভিন্স ম্যাকম্যান জেনেল গ্রান্টের দাবি অস্বীকার করে বলেছেন, “আমি কোম্পানির প্রতি সম্মান দেখিয়ে পদত্যাগ করেছি। জেনেল গ্রান্ট যে অভিযোগে মামলা করেছেন তা মোটেও সত্য নয়, পুরোটাই ভিত্তিহীন।’’
ডেডলাইন এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডাব্লিউডাব্লিউইর সাবেক কর্মকর্তা জেনেল গ্রান্ট কানেকটিকাটের জেলা আদালতে দায়ের করা একটি মামলায় ভিন্স ম্যাকম্যানকে অসদাচরণের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ধারণা হচ্ছে এই কারণেই পদত্যাগ করেছেন ভিন্স ম্যাকম্যান।
আরও পড়ুন: জেফরি এপস্টাইন তালিকা: নাবালিকা পছন্দ বিল ক্লিনটনের, সঙ্গমে…
৭৮ বছর বয়সী ভিন্স ম্যাকম্যান ও ডাব্লিউডাব্লিউই এর প্রধান কর্মকর্তা জন লরিনাইটিসকেও আসামী করা হয়েছে মামলায়। তারা দুইজনই তাকে যৌন হেনস্থা করেছেন বলেও অভিযোগ করা হয় মামলার অভিযোগে।
WWE সভাপতি ও TKO নির্বাহী পরিচালক নিক খান এক বিবৃতিতে জানান, ”ভিন্স ম্যাকম্যান ১৯৮২ সালে যে কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এখন থেকে সেই কোম্পানিতে তার আর কোনও ভূমিকা নেই।”
এর আগে ২০২২ সালে ভিন্স মিকম্যান যৌন অসদাচরণের অভিযোগে WWE এর সভাপতির পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল।মূলত নিজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ঢাকতেই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে। ওই বছর যৌন নিপীড়নের দায়ে মোট ১২ মিলিয়ন ডলার অর্থ জরিমানা চার নারীকে দিতে বাধ্য হন তিনি।
ভিন্স ম্যাকম্যানের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগের পাশাপাশি এক নারী কুস্তিগীরকে জোরপূর্বক ওরাল সেক্স করা ও একজন নারী কর্মচারীকে যৌন হয়রানির জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ওই সময় WWE এর চেয়ারম্যানের পদ হারালেও এবার মাদার কোম্পানি টিকেও থেকেই পদত্যাগ করলেন ভিন্স ম্যাকম্যান।
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে যে ভিন্স ম্যকম্যান ৪৩ বছর বয়সী জেনেল গ্রান্টকে যৌন সম্পর্কের জন্য বাধ্য করেছিলেন, তার নগ্ন ছবিগুলো WWE কর্মীদের সাথে শেয়ার করেছিলেন ও তাকে গ্রুপ সেক্স করতে বাধ্য করেছিলেন।
এছাড়াও থ্রিসাম ( তিন জনের গ্রুপ সেক্স) এর সময় ম্যাকম্যান তার মাথায় মলত্যাগ করেছিলেন এবং দেড় ঘন্টা গোসল না করতে বলেছিলেন। শারীরিক সম্পর্কের পাশাপাশি WWE এর অন্য স্টাফদের সঙ্গে এমনকি ভিনদেশীদের সাথেও যৌনতায় লিপ্ত হতে তাকে প্ররোচণা দেয়া হয় বলেও মামলায় অভিযোগ করেন জেনেল গ্রান্ড।
ইএসপিএন এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, WWE এর চেয়ারম্যান ভিন্স ম্যাকম্যান ও নির্বাহী প্রধান লরিনাইটিস সংস্থাটির সদর দফতরের একটি অফিসে জেনেল গ্রান্টকে যৌন নিপীড়ন করেন বলেও অভিযোগ করা হয় মামলায়। ২০২১-২০২৩ সাল পযন্ত এই কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন জেনেল গ্রান্ট।
২০২২ সালে এনডিএ স্বাক্ষর করার সময় ৩ মিলিয়ন ডলার দেয়ার চুক্তি করা হলেও এখন সেই এনডিএ বাতিল করতে চাইছেন ভিন্স ম্যাকম্যান। এ পর্যন্ত ভিন্স ম্যাকম্যানের কাছ থেকে মাত্র ১ মিলিয়ন ডলার পেয়েছেন। মামলায় ম্যাকম্যানের কাছ থেকে পাওয়া লেখার স্ক্রিনগ্র্যাবও রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে, মামলা ও ভিন্স ম্যাকম্যানের পদত্যাগ TKO-এর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় কারণ আগামী সপ্তায় Netflix-এর সাথে ৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি ঘোষণা করার কথা রয়েছে।
মিসেস গ্রান্টের আইনজীবী অ্যান ক্যালিস মিডিয়াকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন যে তার ক্লায়েন্ট আশা করেন যে মামলাটি “অন্যান্য নারীদের যৌন শিকার হতে বাধা দেবে”।
জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী
ডাব্লিউডাব্লিউই-এর শো’র জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী। ভিন্স ম্যাকম্যানের তত্ত্বাবধান বিশ্বের ১৮০ টিরও বেশি দেশে ও ৩০টি ভাষায় সম্প্রচারিত হয়ে থাকে এই রেসলিং শো।
১৯৪৫ সালে ভিন্স ম্যাকম্যানের জন্ম আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যের পাইনহাস্ট গ্রামে। এটি দেশটির মুর কাউন্টির একটি গ্রাম। চরম দারিদ্র্যে কেটেছে ভিন্স ম্যাকম্যানের ছেলেবেলা। তিনিই WWE নামের বিশ্বের বৃহত্তম পেশাদার রেসলিং নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। আয়োজন করেন রেসলিং প্রতিযোগীতা।
ভিন্সের বাবা একটা ছোট রেসলিং কোম্পানি চালাতেন। সেখানে রিংসাইড ঘোষক হিসেবে কাজ শুরু করেন তরুণ ভিন্স। সেই সময় কোম্পানির নাম ছিল ‘ক্যাপিটাল রেসলিং কর্পোরেশন’।
WWE যাত্রা শুরু যেভাবে:
১৯৮২ সালে ক্যাপিটাল রেসলিং কর্পোরেশন কিনে নেন ভিন্স ম্যাকম্যান। তার আগে ১৯৭৯ সালে এর নাম পরিবর্তন রাখা হয়েছিল WWF অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড রেসলিং ফেডারেশন। ২০০২ অব্দি এই নামই ছিল।
কেনার পর কোম্পানির চেহারা আমূল পরিবর্তন করেন ভিন্স ম্যাকম্যান। একটা সময় এখানে পেশাদার কুস্তিগিররাই আসতেন। লড়াই হতো তবে ভিন্স ম্যাকম্যান এই লড়াইকেই আরও চটকদার করে তুলতে কাজ শুরু করলেন।
কুস্তির রিংয়ে আমদানি করলেন স্ক্রিপ্ট। পুরো মারামারিটাই ছকে বাঁধা। আগে থেকেই ঠিক করা কে, কীভাবে লড়বে। সাথে চালু হলো উত্তেজক কথার লড়াই, গান বাজনার মতোন আনন্দদায়ক বিষয়বস্তু। যুক্ত করা হয় নারী রেসলারও।
৯০-এর দশকে WWF-এর দর্শক সংখ্যায় ভাঁটা পড়েছিল। সেই সময়ই স্ক্রিপ্টের আমদানি করেন ভিন্স। এর পাশাপাশি সুন্দর নারীদের সম্পৃক্তা ম্যাজিকের মতো কাজ হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে আর WWF-কে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
অন্যান্য কোম্পানির কুস্তিগিরদেরও নিজের দলে টানতে শুরু করেন ভিন্স মিকম্যান। কুস্তি পৌঁছে যায় আমজনতার ড্রয়িং রুমে। ছোটদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় রেসলিং শো। ধীরে ধীরে WWE মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম রেসলিং কোম্পানিতে পরিণত হয়। আর এর জনপ্রিয়তা ছড়ায় গোটা বিশ্বে।
শেয়ার বাজারের তালিকাভুক্তি
১৯৯৯ সালে শেয়ার বাজারের তালিকাভুক্ত হয় ভিন্স ম্যাকম্যানের কোম্পানি। ১৭ কোটি ডলারের আইপিও বিক্রি হয়। ততদিনে WWF এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ইন্ডাস্ট্রিতে রুপান্তরিত হয়।
প্রতি সপ্তাহে ২ কোটির বেশি মানুষ এই রেসিলিং শো দেখেন। তবে এই শো ঘিরে কিছু বদনামও হয়। ভিন্স ম্যাকম্যানের বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ ও স্টেরয়েড ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ উঠে।
বিশ্বের সবচেয়ে ‘ধনী’ খেলোয়াড়
আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসি, ভারতীয় ক্রিকটোর বিরাট কোহলি, পর্তুগিজ খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর জনপ্রিয়তা সারা বিশ্বে। তবে তাঁরা কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রীড়াবিদ না। তাদের চেয়েও ধনী খেলোয়াড় রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী খেলোয়াড়ের নাম ভিন্স ম্যাকম্যান।
ভিন্স ম্যাকম্যান হলেন সেই ব্যক্তি যিনি সবচেয়ে বেশি উপার্জন করেছেন। ভিন্স ম্যাকম্যানের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি।
ভিন্স ম্যাকম্যান একজন বড় ব্যবসায়ী। ৪০ বছর ধরে রেসলিং কোম্পানির মালিকানা ধরে রাখেন। এই কোম্পানি তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে কিনেছিলেন।
ভিন্স মিকম্যান কুস্তিগীর ছিলেন। তিনি নিজেও বড় বড় ইভেন্টে অংশ নিয়েছেন। রিংয়ে তিনি দ্য রক, আন্ডারটেকার ও ব্রক লেসনার এর মতো কুস্তিগীরদের বিরদ্ধেও লড়াই করেছেন।
ভিন্স ম্যাকম্যান এর দামি গাড়ির শখ। তাঁর গ্যারাজে বহু দামি গাড়ি শোভা পাচ্ছে। প্রায় তিনি রেসলিং শোতে গাড়ি নিয়ে আসতেন। এমনকি কোর্টের ভিতরেও তিনি মাঝে মাঝে বিশ্বের দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতেন।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মোট সম্পদ ভিন্স ম্যাকম্যানের অর্ধেকও নয়। রোনাল্ডোর মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ও ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্টের মাধ্যমে ৬৯৩ কোটি টাকা আয় করেন তিনি।
ভারতীয় ক্রিকেটার বিরাট কোহলির সম্পদের দুই খেলোয়াড়ের থেকে অনেক কম। সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিরাট কোহলির মোট সম্পদ ১০৫০ কোটি টাকা। ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্টের মাধ্যমে তিনি সবচেয়ে বেশি আয় করেন।
তথ্যসূত্র: ইয়াহু স্পোর্টস, ডেডলাইন, ইএসপিএন, বিবিসি, সিএনএন ও দ্য গার্ডিয়ান