নেলসন ম্যান্ডেলার স্মৃতিধন্য রোবেন দ্বীপ নিয়ে এই নিবন্ধ। নির্বাসনের জন্য এক সময় বিখ্যাত হয়েছিল বেশ কয়েকটি সাগর ও মহাসাগরবেষ্টিত দ্বীপ। এসব দ্বীপে স্থান হয়েছিল ফরাসি সমর নায়ক নেপোলিয়ন বেনাপোর্ট, আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাসহ বিখ্যাত সব মানুষের।
নানা কারণে এসব দ্বীপ আজও আলোচিত। ইতিহাসে স্থান করে নেওয়া আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে তেমনি এক দ্বীপের নাম রোবেন দ্বীপ।
নিস্ক্রীয় কারাগার
দক্ষিণ আফ্রিকার বিধানিক রাজধানী কেপটাউন শহরের সমুদ্র উপকূল থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুেেদ্র ৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনজুড়ে রোবেন দ্বীপের অবস্থান। আফ্রিকানদের কাছে এটি ‘ রোবেনিল্যান্ড’ নামে অধিক পরিচিত।
১৭ শতক থেকে প্রায় ৪০০ বছর ধরে কারাবাস, নির্বাসন ও বিচ্ছিন্নতার স্থান হিসেবে বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ বন্দিদের নির্বাসন ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের নির্বাসনের জন্য ব্যবহৃত হয় এ দ্বীপটি। এখন এটি নিষ্ক্রীয় কারাগার।
নেলসন ম্যান্ডেলার ১৮ বছর অতিক্রম
১৯৬২ সালের শুরুতে কৃষ্ণাঙ্গ, ভারতীয় ও মিশ্রজাতির বেশিরভাগ বন্দিকে দ্বীপে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা ও পরবর্তীতে দেশটির প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা। ২৭ বছর কারা ভোগের মধ্যে ১৮ বছর এই দ্বীপের কারাগারে কেটেছে নেলসন ম্যান্ডেলার।
১৯৬৪ সালের জুনে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগ এনে তাকে এই দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয়। সেখানে ৮ বাই ৭ ফুটের একটি কক্ষে রাখা হয় ম্যান্ডেলাকে।

মাত্র একটি খড়ের মাদুর ও মলমূত্র ত্যাগের জন্য একটি বালতিই ছিল নেলসন ম্যান্ডেলার ওই কক্ষের আসবাব। রোবেন আইল্যান্ড কারাগারের সঙ্কীর্ণ কুঠুরিই ছিল ৪৬৬ নম্বর বন্দি ম্যান্ডেলার স্থায়ী ঠিকানা।
এখানেই খুবই কষ্টে দীর্ঘ ১৮টি বছর দিনাতিপাত করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়া নেলসন ম্যান্ডেলা। তৎকালিন শাসকরা তার ওপরে অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলার স্মৃতিধন্য রোবেন দ্বীপ এ আসলে আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে।
দ্বীপটির আদর্শিক নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয়’
যদিও এটি নেলসন ম্যান্ডেলার কারাবাসের স্থানের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত, রোবেন দ্বীপ হল কেপ টাউনের সামাজিক এবং প্রাকৃতিক ইতিহাসের একটি সাক্ষী। এটি বর্ণবাদ ব্যবস্থার বর্বরতার একটি স্মরণীয় সংমিশ্রণ কিন্তু মানব চেতনার দৃঢ়তা এবং প্রকৃতির স্থিতিস্থাপকতার একটি অনুস্মারকও।
দ্বীপে পাঠানো বন্দিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণই ছিল নেলসন ম্যান্ডেলার ভাবশিষ্য। নেলসন ম্যান্ডেলার স্মৃতিধন্য রোবেন দ্বীপ এর আরেক আদর্শিক নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয়’।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী ও মুক্তি সংগ্রামের অনেক নেতাকে বিভিন্ন সময় এই দ্বীপে অভ্যন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কগালেমা মোটলানথে ও জ্যাকব জুমা উল্লেখযোগ্য। এ সময় তাঁরা নানা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সহ্য করেছেন। তারা দুজনই পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
শুরুর দিকের কথা
শুরুর দিকে সামুদ্রিক পাখি, আফ্রিকান পেঙ্গুইন, সিল ও কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রাণীর বসবাস ছিল এই দ্বীপে। প্রাথমিকভাবে কৃষিকাজে ব্যবহৃত হলেও পরবর্তী সময়ে ক্রীতদাসদের জন্য নির্ধারিত হয় এই দ্বীপ। রোবেন শব্দটি ওলন্দাজ শব্দ যার অর্থ ‘সিল’। সেখান থেকেই দৃষ্টিনন্দন দ্বীপটির নাম হয়েছে ‘সিল দ্বীপ’।
দ্বীপটি সমতল ও সমুদ্রতল থেকে মাত্র কয়েক মিটার ওপরে বিদ্যমান। বরফ যুগের প্রায় ১২ হাজার বছর আগে ক্রমবর্ধমান সমুদ্রস্তর উপকূল থেকে এই দ্বীপকে পৃথক করেছে। ১৫০০ শতকের প্রথমার্ধেও বিশ্ববাসীর কাছে রোবেন ছিল অজানা দ্বীপ।
১৪৮৮ সালে জাহাজ নোঙরের সময় দ্বীপটির অস্তিত্ব খুঁজে পান পর্তুগিজ পর্যটক বাতোলোমিও ডায়াস। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ওলন্দাজরা বসতি স্থাপন করে অল্প সময়ে এই দ্বীপকে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে।
ঊনিশ শতকে বিভিন্ন জাতির আফ্রিকান ও ভারতীয় মুসলিম নেতাদেরও সেখানে নির্বাসন দেয়া হয়। অনেককে মিথ্যা অপরাধে অভিযুক্ত করে আবার সম্পূর্ণ বিনা অপরাধেও কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এ দ্বীপে।
জাতীয় জাদুঘর ঘোষণা
১৯৯৭ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার রোবেন আইল্যান্ডের বন্দিশালাকে দেশের অন্যতম জাতীয় জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো দ্বীপটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এর পরই বিশ^বাসীর কাছে পরিচিত নাম হয় রোবেন দ্বীপ।
বন্দিরাই এখন গাইড
বর্তমানে অনেকে এই দ্বীপের গাইড হিসেবে কাজ করছেন, যারা এক সময় এই দ্বীপেই রাজনৈতিক বন্দি ছিলেন। তারা রোবেন দ্বীপের ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন দর্শণার্থীদের কাছে। প্রায় ছয় কিলোমিটারের এই দ্বীপে সহজেই হেঁটেও বেড়ানো যায়। তবে ভ্রমণের অংশ হিসেবে ট্যুর বাসও আছে।
মৃত বন্দিদের সমাধি
এক সময় এখানে কুষ্ঠরোগ নিরাময়কেন্দ্র ও মানসিক হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। সে সময় কুষ্ঠরোগের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতালও স্থাপন করা হয়। সামরিক ঘাঁটি হিসেবেও এর ষোল আনা ব্যবহার হয়েছে। ছিল পোস্ট অফিসও।

এই দ্বীপের কবরস্থানও রয়েছে, যেখানে মৃত বন্দিদের সমাধিস্থ করা হয়েছে। রয়েছে চুন ও নীল পাথরের খনিও। রয়েছে বাতিঘরও। বাতিঘরটি দ্বীপের সর্বোচ্চ উঁচু স্থান মিন্টু পাহাড়ে অবস্থিত।
ঝলকানি বাতির দ্রুতি
১৮৬৫ সালে নির্মিত হলেও বাতিঘরে ১৯৩৮ সাল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। বাতিঘরে ঘূর্ণন বাতির পরিবর্তে একটি ঝলকানি বাতি ব্যবহার করা হয়, যা প্রতি সাত সেকেন্ড অন্তর ৫ সেকেন্ড সময়ের জন্য জ্বলে ওঠে। এর আলো ২৮ মাইল থেকেও দেখা যায়, যা জাহাজগুলোর নেভিগেশন সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
মতুরোর স্মরণে মসজিদ
কেপটাউনের প্রথম ইমাম মাদুরার যুবরাজ সাঈদ আব্দুর রহমান মতুরো স্মরণে নির্মাণ করা হয় একটি মসজিদ যা মতুরো ক্রামোত নামে পরিচিত। এটি মূলত আব্দুর রহমান মতুরোর সমাধি। এটিও একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে রোবেন দ্বীপে।
মুসলিম তীর্থযাত্রার এক ধর্মীয়-স্থান মতুরো ক্রামোত। মুসলিম পর্যটকরা এই দ্বীপ ভ্রমণে আসলে মতুরো মসজিদে নামাজ আদায় করেন। শ্রদ্ধায় মাথায় অবনত করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।
গুড শেফার্ড’ গির্জা
পুরুষ কুষ্ঠরোগীদের জন্য নির্মিত পরিকল্পিত একটি গির্জাও রয়েছে রোবেন দ্বীপে। এর নাম ‘গুড শেফার্ড’ গির্জা। এটি দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাঙ্গলীয় গির্জার মালিকানাধীন ও রোবেন দ্বীপের একমাত্র ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভবন। খ্রিস্টীয় ধর্মের অনুসারীদের কেউ কেউ এখানে এসে প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন। তবে খুবই সময়ের জন্য। কারণ এখানে আসা সবাই দলগতভাবে ঘুরে থাকে।
গ্যারিসন গির্জা

দ্বীপের রয়েছে গ্যারিসন গির্জা নামের আরেকটি দর্শনীয় স্থান। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার এই গির্জায় প্রতি বছর ভালোবাসা দিবসে গণ বিয়ের আয়োজন করে থাকে। দেশ বিদেশের অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা বা পছন্দের মানুষকে নিয়ে চলে যান ইতিহাসের শামিল হতে দেখা যায়।
বিশ্ব নেতাদের আগমন
নেলসন ম্যান্ডেলার স্মৃতিধন্য রোবেন দ্বীপ এর এই কারাগার পরিদর্শনে গিয়ে মাথা নত হয়ে এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার। তিনি ম্যান্ডেলার বন্দিশালায় গিয়ে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো, ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি ও আরেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও সস্ত্রীক রোবেন আইল্যান্ড পরিদর্শন করেন।
বছরজুড়েই থাকে উন্মক্ত
পর্যটকদের জন্য দ্বীপটি সারা বছর খোলা রাখা হয়। তবে শীতকালে আবহাওয়ার কারণে ফেরি কম চলাচল করে ও সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে শীত প্রিয়দের বিমুখ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ বিকল্প পথে জাহাজেও করেও যাওয়া যায় রোবেন দ্বীপে।
গ্রীস্মকালে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড়
ঐতিহাসিক স্থানের স্বীকৃতি পাওয়ায় দৈনিক ১ হাজার ৮০০ মানুষ দৈনিক ভ্রমণের সুযোগ পান রোবেন দ্বীপে। বহু দূর দূরান্তের মানুষ এখানে আসেন এর সৌন্দয্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে। তুলনামূলকভাবে পর্যটকদের ভিড় শীতকালের চেয়ে গ্রীস্মকালে বেশি থাকে। কারণ এই সময় সাগরের আবহাওয়া ভালো থাকে।
দ্বীপে যাওয়া-আসা
যাতায়াত ও ভ্রমণের জন্য সব মিলিয়ে আনুমানিক চার-পাঁচ ঘণ্টা ব্যয় করলেই সুন্দরভাবে ঘুরে আসা যায় নেলসন ম্যান্ডেলার স্মৃতিবিজড়িত দ্বীপ রোবেনে। বিশ^ব্যাপি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নেলসন ম্যান্ডেলার লাখো অনুসারি। নেলসন ভক্তরা সারা বছরই ভিড় জমান এই দ্বীপে।
কেপটাউনের ভিএন্ডএ ওয়াটারফ্রন্টের ম্যান্ডেলা গেটওয়ে থেকে সকাল ৯টা, সকাল ১১টা ও দুপুর ১টায় একাধিক ফেরি দ্বীপে যাত্রা করে। স্বাভাবিক আবহাওয়ায় দ্বীপে পৌছাতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগে। তবে বৈরি আবহাওয়ায় এই সময় বেশি লাগে। আবার কখনো কখনো দিগুণ সময় লাগে দ্বীপে যেতে।
দ্বীপ ভ্রমণের খরচাপাতি
টিকিটের মূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আফ্রিকার মুদ্রায় ৩৬০ র্যান্ড ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ১৮০ র্যান্ড, যা বাংলাদেশে মুদ্রায় প্রায় আড়াই হাজার টাকা ও দেড় হাজার টাকার কাছাকাছি। প্রতিদিন অনেকে হেলিকপ্টারে চড়েও এই দ্বীপে ঘুরতে যান। এতে জনপ্রতি খরচ হতে পারে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা।
টিকেট বুকিং
রোবেন দ্বীপে ভ্রমণের আগেই ফেরির জন্য অগ্রীম আসন নিশ্চিত করে নেয়া যায়। ভ্রমণের কয়েকদিনের আগে থেকেই আগাম টিকেট বুকিং করার সুযোগ থাকে। রোবেন দ্বীপ জাদুঘর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনেও এই টিকেট বুকিং করা যায়।
লেখক: মোহাম্মদ রবিউল্লাহ, সাংবাদিক, অনুবাদক ও কলামিস্ট
ইমেল: [email protected]