খেজুরকে অনেক সময়ই চিনির বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ৩০ গ্রাম খেজুরের মধ্যে রয়েছে ৯০ ক্যালোরি। ১৩ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম। ২.৮ গ্রাম ফাইবার ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ। প্রতিদিন কতগুলো খেজুর খাওয়া উচিৎ এই নিয়ে আমাদের অনেকের জিজ্ঞাসা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেজুর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে খেলে শারীরিক অসুস্থতা, জ্বালা যন্ত্রণা কমে যেতে পারে। খেজুরে ক্যালোরি, ক্যালসিয়াম ছাড়াও আয়রন, পটাশিয়াম রয়েছে, যা শরীরের জন্য খুবই উত্তম। তবে এর অপকারিতাও রয়েছে। আসুন আমরা আজ খেজুরের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
খেজুরের উপকারিতা
দেহকে সচল ও কার্যক্ষম রাখতে শক্তির প্রয়োজন। এর অভাবে দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে ও মানসিক অবসাদ সৃষ্টি হয়।
এসব ক্ষেত্রে শর্করা জাতীয় খাদ্য শক্তির উৎস হিসেবে খেজুর খাদ্য শক্তির উল্লেখযোগ্য উৎস হিসেবে কাজ করে। প্রকৃতির প্রায় সব গুণই খেজুরে বিদ্যমান রয়েছে। খেজুর মানব দেহের জন্য মহৌষধ।
রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায় খেজুর
একজন সুস্থ মানুষের শরীরে যতটুকু আয়রন প্রয়োজন, তার প্রায় ১১ ভাগ পূরণ করে খেজুর। খেজুরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
কোলেস্টেরল কমায়
রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমাতে খেজুরের জুড়ি মেলা ভার। হাই কোলেস্টেরলের ক্ষেত্রে পশু প্রোটিনে যে সমস্যা, খেজুরে তা হয় না। অল্প পরিমাণে রোজ খেজুর খাওয়ার অভ্যাসে কোলেস্টেরলের রোগীদের জন্য খুবই উপকারী।
আরো পড়ুনঃ মাশরুম খাওয়া জরুরী কেন ?
হিমোগ্লোবিন বাড়ায়
খেজুরে থাকা আয়রন শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ায়। শরীরে রক্ত সরবরাহ করে। শরীরের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বহু গুণে বৃদ্ধি করে খেজুর।
দুর্বল হার্ট মজবুত করে
যাদের হার্টের সমস্যা আছে, তাদের জন্য খেজুর জড়ি মেলা ভার। কারণ খেজুর দুর্বল হার্টকে মজবুত করতে সক্ষম। রোজ খেজুর খেলে হার্টের সমস্যা সমাধানে তা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
চুলের পড়া রোধ করে
অনেক সময়ে চুলের উজ্জ্বলতা হারিয়ে রুক্ষ ও শুষ্ক ভাব চলে আসে। খেজুরে পুষ্টিতে পরিপূর্ণ তেল থাকে যা চুলের রুক্ষ ও শুষ্কতা কমানোর পাশাপাশি চুল পড়াও রোধ করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধী খেজুর
খেজুর ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাছাড়া মুখগহ্বরের ক্যান্সার রোধেও বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে বহু গুণ সম্পন্ন খেজুর।
সকালে খেজুর খাওয়ার উপকারিতা
সারা দিনে শরীরকে সতেজ রাখতে খেজুর প্রকৃতির সেরাদের সেরা খাদ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সকালে খালি পেটে খেজুর খাওয়ার বহু উপকারিতা রয়েছে। চলুন জেনে নিই সকালে খালি পেটে খেজুর খাওয়ার উপকারী সম্পর্কে
দূরে থাকবে বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য
খেজুরে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য ও বদহজমের সমস্যা দূর করে। শুকনো ও শক্ত খেজুর সারা রাত পানিতে ভিজিয়ে সকালে খালি পেটে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য অনেকাংশে দূর হয়।
এছাড়া মুখের লালাকে ভালোভাবে খাবারের সঙ্গে মিশতে সাহায্য করে খেজুর। ফলে বদহজম অনেকাংশে দূর হয়ে যায়।
খেজুর খেলে সক্রিয় থাকবে মস্তিষ্ক
বহুগুণী ফল খেজুর মস্তিষ্ককে প্রাণবন্ত রাখতে সহায়ক। সকালে খেজুর খেলে ক্লান্ত শরীরে শক্তির যোগান দিতে ভুল করে না। এতে সক্রিয় থাকে মস্তিষ্ক।
আরো পড়ুনঃ শিশুদের মনোযোগ বাড়ায় যে ৫ খাবার
ওজন কমানোর ওস্তাদ খেজুর
খেজুরে প্রচুর পরিমাণে থাকা ফাইবার ক্ষুধা কমিয়ে অতিরিক্ত খাওয়া থেকে দূরে রাখে। সকালে খেজুর খেলে অধিক পরিমানে খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়, ফলে ওজন কমতে শুরু করে।
খেজুর কি গর্ভবতী নারীদের জন্য সহায়ক ?
খেজুরে থাকা আয়রন, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান গর্ভবতী নারীদের জন্য অপরিহার্য। গর্ভবতী নারীরা সহজেই ১-২টি খেজুর সকালে খেলে তার উপকার সারাদিন পাবেন।
শরীরের দুর্বলতা কাটাতে অনেক সাহায্য করে ও ডেলিভারীর পর মায়েদের অতিরিক্ত রক্তপাত বন্ধে খেজুর সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে বুকের দুধ বৃদ্ধিতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
ত্বককে সতেজ রাখে খেজুর
বয়স বাড়ার কারণে অনেকের মুখের চামড়া কুঁচকে যায়। খেজুরে থাকা ভিটামিন বি ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে নিয়ম করে খেজুর খেলে ধীরে ধীরে দাগ মিলিয়ে যায়।
খুশখুশে কাশি দূর করে
খুশখুশে কাশি দূর করতে ১/২টি খেজুর সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সকালে ঘুম থেকে উঠে খেজুরসহ পানি পান করলে খুশখুশে কাশি থেকে রক্ষা মিলবে।
দিনে কয়টি খেজুর খাওয়া উচিত?
দিনে কয়টি খেজুর খাওয়া উচিত এই নিয়ে অনেকে দ্বিধায় থাকেন। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় দিনে অন্তত তিনটি অথবা সর্বোচ্চ ৬ টির বেশি খেজুর খাওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
ফলে দিনে যদি কিছু পুষ্টিকর জিনিস নিজের ডায়েটে রাখতে চান, তাহলে খেজুর রাখতে পারেন।
খেজুর খেলে কী ওজন বাড়ে?
খেজুরে থাকে ভিটামিন এ, সি, ই, কে, বি২, বি৬, প্রোটিন , শর্করা ও থায়ামিন। এসব উপাদান সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। নিয়মিত খেজুর খেলে ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। তবে শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমার প্রবনতা থাকলে তাঁদের খেজুর পরিমিত খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞগণ।
শুকনো খেজুর খাওয়ার নিয়ম কি?
শুকনো খেজুর খাওয়ার উপকারিতা হলো প্রতিটি খেজুরে রয়েছে ২০ থেকে ২৫ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। রক্ত স্বল্পতায় ভোগা রোগীরা প্রতিদিন খেজুর খেতে পারেন।
শুকনো খেজুর সারারাত এক গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও গুড়ো করে খাওয়া যায় যেকোন পানীয়র সাথে। ছোট বাচ্চারা যারা খেজুর খেতে পারে না তাদেরকে শুকনো খেজুর গুড়ো করে দুধের সঙ্গে মিক্স করে তার সাথে মধু দিয়ে খাওয়ালে এর পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি পাবে অনেক।
কোন খেজুর সবচেয়ে ভাল
বিভিন্ন আকৃতির প্রায় ৬০০ রকমের খেজুর দেখা যায় বিশ্বে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের খেজুর চাষ হয়। সেসব খেজুর খেতে একদিকে সুস্বাদু অন্যদিকে পুষ্টিগুণেও পরিপূর্ণ।
তবে কোন খেজুর সবচেয়ে ভাল এই প্রশ্নের উত্তরে সবার আগে আসে আজওয়া, মেজুল, ওমানি, ডেগলেট নূর, হালাউয়ি ও মাজাফাতির খেজুরের নাম।
আজওয়া খেজুর
কালো, নরম আজওয়া খেজুর খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ। খেতেও বেশ ভালো। সৌদি আরবের মদিনাতে এই খেজুর চাষ হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এই খেজুর খুব পছন্দ করতেন।
মেজুল খেজুর
বিশ্বের একটি জনপ্রিয় খেজুর বলা যায় মেজুলকে। মরক্কোতে চাষ হয় এই খেজুর। বর্তমানে আমেরিকাসহ অনেক দেশেই এই খেজুর পাওয়া যায়। বড় আকারের বাদামী রঙয়ের এই খেজুরের বেশ চাহিদা রয়েছে।
ওমানি খেজুর
বড় আকারের রসালো মিষ্টি স্বাদের খেজুর হলো ওমানি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানেই চাষ হয় এই জাতের খেজুর। সোডিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রণের প্রচুর সমাহার থাকা ওমানি খেজুরের চাহিদা বিশ্বব্যপি।
ডেগলেট নূর খেজুর
আলজেরিয়াতে চাষ হয় মাঝারি আকারের বাঁকা দেখতে, মিষ্টি স্বাদের ডেগলেট নূর খেজুর। সূর্যের আলোতে রাখলে ডেগলেট নূরের ভেতরটা সোনালী দেখায়। এটিকে ‘খেজুরের রাণী’বলা হয়।
হালাউয়ি খেজুর
ইরাকের হেলা নগরে চাষ হয় হালাউয়ি খেজুরের। সোনালী- বাদামী রঙয়ের এই খেজুর বেশ সুস্বাদু। এটি ভালো খেজুরের মধ্যে একটি। এটির চাহিদাও সারা বিশ্বে রয়েছে।
মাজাফাতি খেজুর
নরম, ঘন বাদামি রঙয়ের মাজাফাতি খেজুরের চাষ হয় ইরানের কেরমান নগরীতে। খেতে মিষ্টি মাজাফাতি খেজুরের স্বাদ অনেকটা চকোলেটের মতো। ভিটামিন এ,বি,সি, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়ামও সমৃদ্ধ এই খেজুর ভূবন বিখ্যাত।
এসব খেজুরের পাশাপাশি ইরানের মরিয়ম, সৌদি আরবের আম্বার, সুকারি মাবরুম খেজুর বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় খেজুর।
এছাড়াও তুরস্ক, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের খেজুরও স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় খেজুর সারা বছরই পাওয়া যায়।
১০০ গ্রাম খেজুরে কত ক্যালরি থাকে?
প্রতি ১০০ গ্রাম পরিষ্কার ও তাজা খেজুর ৩২৪ মিলিগ্রাম ক্যালরি থাকে। ক্যালরির পরিমাণ বেশি থাকায় শিশুদের জন্যও অনেক উপকারী একটি ফল খেজুর।
খেজুর খাওয়ার অপকারিতা
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহু শারীরিক পুষ্টিগুণের আধার হওয়া সত্বেও খেজুর এর কিছু অপকারিতা রয়েছে। সবার জন্য খেজুর খাওয়া ভালো নয়। এতে শারীরিক সমস্যা বাড়তে পারে।
পেটের ব্যথা বা ডাইরিয়ায় ভুগলে কিছুদিন খেজুর খাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। খেজুর খেলে অনেক সময় ল্যাক্সেটিভ এফেক্ট হয়, যা পেট খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কিডনি রোগীদের জন্য বেশি পটাশিয়াম খুবই ক্ষতিকারক। খেজুরে পটাশিয়াম থাকায় এর কিছু অপকারিতা রয়েছে। খেজুর থেকে কিডনি রোগীদের দূরে থাকাই ভাল। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
পেটের সমস্যায় প্রায়শই যদি ভুগে থাকেন, তাহলে খেজুর খাওয়ার প্রয়োজন নেই। যদি ইচ্ছে থাকেও, তাহলে সীমিত মাত্রায় খেতে হবে খেজুর।
ওজন বেড়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তা যাঁদের তাঁদের খেজুর না খাওয়ার পরামর্শই দেন বিশেষজ্ঞরা। ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি অর্থাৎ শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমার প্রবনতা থাকলে তাঁদের ক্ষেত্রে খেজুর অপকারিতা বয়ে নিয়ে আসতে পারে।
খেজুরের চাষাবাদ বা খেজুর গাছের উৎপত্তির সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না গেলেও ধারণা করা হয়, পারস্য উপসাগরের উপকূলীয় দেশগুলোতে প্রথম খেজুরের চাষাবাদ হয়েছিল।
সুদীর্ঘকাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে খেজুর খুবই জনপ্রিয় ফল। তবে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশে খেজুর প্রধান সুস্বাদু খাদ্য।