গ্র্যান্ড প্যালেস। নাম শুনেই শিহরণ জাগে। দূর থেকে দেখেই শুরু হয় ভাললাগা। কাছে গেলে সেই ভালোলাগা বাড়তেই থাকে। স্থাপত্যকর্ম সৃজনশীলতার অন্যতম প্রতিমা, যার প্রতিফলন মিলবে থাইল্যান্ডের গ্র্যান্ড প্যালেস বা মহা প্রাসাদে। গ্র্যান্ড প্যালেস থাই স্থাপত্য শৈলীর সর্বোচ্চ প্রতীক।
গ্র্যান্ড প্যালেসের প্রতিষ্ঠা ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে, থাই রাজা প্রথম রামা, বুদ্ধ ইয়োদফা চুলালোকের হাত ধরে। চাও প্রায়া নদীর তীরে রাজধানী ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয় এই মহাপ্রাসাদ। একটানা দেড়শ বছর এই প্রাসাদই ছিল থাই রাজ পরিবারের বাসস্থান ও প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু।
রাজপ্রাসাদ ছাড়াও প্রাসাদ এলাকায় ছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, উপাসনালয়, আনুষ্ঠানিক হল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে থাইল্যান্ডের অন্যতম জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র প্রাসাদটি।প্রাথমিকভাবে গ্যান্ড প্যালেস আজকের তুলনায় অত্যন্ত ছোট পরিসরে নির্মাণ করা হয়।
পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজা উত্তরাধিকার সূত্রে রাজ সিংহাসনে আসীন হয়ে ২০০ বছর যাবত প্রাসাদটির পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও আধুনিকীকরণ করতে থাকেন। অবশেষে এটি রূপ নেয় চাকচিক্যময় ও জাঁকজমক পূর্ণ প্রাসাদে। চৌকণা বিশিষ্ট এ প্রাসাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল চারপাশের প্রাচীর ভিন্ন ভিন্ন অবকাঠামোতে নির্মিত। পুরো প্রাসাদটির রয়েছে চারটি আলাদা অংশ। যার প্রতিটি অংশের রয়েছে পৃথক পৃথক অনন্যতা।
নির্মাণ ইতিহাস:
গ্র্যান্ড প্যালেসের স্থান অনেকটা অপরিকল্পিত বা অগোছালোভাবে নির্ধারণ করা হয়। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র চাও প্রায়া নদীর অতি সন্নিকটে প্রাসাদের জায়গা নির্ধারণ করা হয়। গ্র্যান্ড প্যালেসের এমন ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা সহজ হয়।
চক্রী রাজবংশের স্থপতি প্রথম রাজা রামা এ স্থানটি রাজ প্রাসাদের জন্য উপযুক্ত বলে ঠিক করেন। কিন্তু ওই সময় সেখানে চীনের বিপুল জনগোষ্ঠী বসবাস করত। রাজা তাদের অন্যত্র স্থানান্তর হতে বাধ্য করেন। বর্তমানে এ জনগোষ্ঠী শহরের বাইরের যে এলাকায় বসবাস করেন, তা এখন ‘চীনা টাউন’ নামে পরিচিত।
রাজার নির্দেশে ১৭৮২ সালে প্রাসাদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৮০০ সাল পর্যন্ত এর কাজ চলতে থাকে। ১৭৮২ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত গ্র্যান্ড প্যালেস থাইল্যান্ডের রাজ শাসকবর্গের বাসভবন ও প্রশাসনিক এমনকি ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মজার ব্যাপার হলো, বর্তমানে এই প্রাসাদে রাজ পরিবারের কেউ থাকেন না, প্রশাসনিক দপ্তরও আর নেই।
১৯৩২ সালে প্রাসাদ থেকে সকল সরকারি বিভাগসমূহ খালি করা হয়। এটি বর্তমানে ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান ও তীর্থক্ষেত্র এবং শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় বিশেষ কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে প্রাসাদটির পুরো আঙ্গিনা জনগণের জন্য উম্মুক্ত নয়। কিন্তু যতটুকু দেখার সুযোগ রয়েছে তাতে দেখার রয়েছে অনেক কিছু।
প্রাসাদের মূল অংশে ঢুকতেই চোখে পড়বে পাহারারত দানবাকৃতির গারুদা-মুর্তি। গারুদা হচ্ছে পৌরাণিক চরিত্র, যা শক্তির প্রতীক। আছে রামায়ণের কাহিনী সংবলিত সুনিপুণ দেয়ালচিত্র। চোখ ধাঁধানো কারুকার্য খচিত সব স্থাপনা। কোনোটা রাজদরবার, কোনোটা উপাসনালয়, থাকার ঘর, গ্রন্থাগার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সভা-সম্মেলন কক্ষ। প্রাসাদ-চৌহদ্দির প্রতিটি স্থাপনাই অতুলনীয়, স্থপতি শিল্পীরা যেন তাদের সৃজনশীলতা ফুটিয়ে তুলতে কোনো কার্পুণ্য করেননি।
তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে মূল উপাসনালয়টি, যেখানে অধিষ্ঠিত পান্নার তৈরি বুদ্ধমূর্তি, থাই ভাষায় যার নাম ‘ওয়াত প্রা ক্যাও’। সাধ ও সাধ্যের সুসমন্বয় ঘটিয়েই দেশি-বিদেশি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এই বুদ্ধমূর্তি দর্শনে আসেন। আর সাধারণ পর্যটকদের কাছে এর আকর্ষণ বহুমাত্রিক।
মহাপ্রাসাদের কিছু স্থাপনা থাই ও ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রন, যা রাজদরবার ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য থাই রাজা পঞ্চম রামা, চুলালংকর্ন ১৯ শতকে প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রাসাদের নকশা:
গ্র্যান্ড প্যালেস ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্রে ২ লাখ ১৮ হাজার বর্গমিটার প্লটের ওপর অবস্থিত। মূল এলাকাটি পুরোপুরি না হলেও চৌকণ বিশিষ্ট। প্রাসাদটি চারটি মূল এলাকার সমন্বয়ে গঠিত।
এগুলোকে বলা হয়, আউটার কোর্ট (বাইরের অংশ), ইনার কোর্ট (অভ্যন্তরীণ অংশ), সেন্ট্রাল কোর্ট (কেন্দ্রীয় অংশ) ও এমারেল্ড বুদ্ধ মন্দির। এ প্রত্যেকটি অংশের রয়েছে আলাদা আলাদ কার্যক্রম ও উদ্দেশ্যে। চৌকণাবিশিষ্ট হওয়ায় পরিদর্শনের জন্য প্রাসাদটির চারদিকে অত্যন্ত সহজভাবে পথ নির্দেশিকা দেয়া আছে। এ চার অংশের মধ্যে কেবল বাইরের অংশ দর্শনার্থীদের জন্য উম্মুক্ত রাখা হয়েছে।
চারটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা গ্র্যান্ড প্যালেসের চারদিকে চারটি সড়ক রয়েছে। উত্তর দিকে সানাম লুয়াং ও না ফ্রা লান রোড, পশ্চিমে মহারাজা রোড, পূর্বে সানামচাই রোড ও দক্ষিণে থাই ওয়াং রোড অবস্থিত। ভিন্ন ভিন্ন অবকাঠামোর অসংখ্য ভবন, হল, প্যাভিলিয়ন, বাগান ও আঙ্গিনা রয়েছে।
আউটার কোর্ট:
আউটার কোর্ট ‘খেল ফ্রা রাচা থান চান নর্কে’ নামে পরিচিত। প্রাসাদের এ অংশে রয়েছে পথনির্দেশিকা, আছে তথ্য কেন্দ্রও। এছাড়া এখানে একটি ছোট যাদুঘরও রয়েছে। পর্যটকরা মূলত এখান থেকেই পরিদর্শন শুরু করেন। আসল বিষয় হলো আউটার কোর্টে রাজ শাসকদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিভাগের প্রশাসনিক দপ্তর ছিল। যেখানে ছিল রাজার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ। এমনিভাবে সেখানে অস্ত্রাগার, রাজকীয় তক্ষশালা ও অন্যান্য সিভিল প্রশাসনের দপ্তর রয়েছে।
ইনার কোর্ট:
গ্র্যান্ড প্যালেসের দক্ষিণের অধিকাংশ জায়গা নিয়ে ইনার কোর্ট গঠিত হয়েছে। সাধারণত এই অংশটি ক্ষমতাসীন রাজা ও তার স্ত্রী লোকদের বিশেষ ব্যবহারের জন্য নির্ধারণ করা হয়। এ আবাসস্থলে রাণী ও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র স্ত্রীলোকদের হেরেম রয়েছে। অন্যান্য অধিবাসীদের মধ্যে কেবল রাজাদের শিশু সন্তানরা ইনার কোর্টে বাসবাস করতে পারে।
ইনার কোর্টে রয়েছে আবার কয়েকটি অভ্যন্তরীণ আবাসস্থল। যেখানে প্রতিটি রাণী বা রাজাদের অন্যান্য নারী সঙ্গীদের ব্যক্তিগত বাসস্থান রয়েছে। প্রতিটি বাসা বিভিন্ন আকৃতির এবং এসব বাসস্থানের রাজকীয়তা বা জাঁকজমকতা সেখানে বসবাসকারী স্ত্রী লোকের মান অনুযায়ী গড়ে তোলা হয়েছে।
অধিকতর বড় আবাসস্থলটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্ত্রীলোক বাস করেন। আর যে স্ত্রীলোক রাজ সন্তান জন্ম দিতে পারে তার জন্য সেখানে সবচেয়ে বেশি জায়গা বা সুবিধা সংরক্ষিত রয়েছে। প্রাসাদের এ অংশে বসবাস করে তিন হাজারের অধিক বাসিন্দা। যাদের অনেকে কখনই আঙ্গিনা ত্যাগ করে না।
সেন্ট্রাল কোর্ট:
গ্র্যান্ড প্যালেসের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল মিডল কোর্ট। নাম থেকে বোঝা যায় মিডল কোর্টটি প্রাসাদের কেন্দ্রীয় অংশে অবস্থিত। এ অংশে অধিক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ও বাসভবন রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মধ্যবর্তী এ অংশটি আরও তিনটি উপবিভাগে বিভক্ত।
এমারেল্ড বুদ্ধ মন্দির:
এমারেল্ড বুদ্ধ মন্দির ‘ওয়াত ফ্রা কায়েও’ নামে পরিচিত। গ্র্যান্ড প্যালেসের পর্যটকদের মূল উদ্দেশ্যে থাকে এ মন্দিরটি পরিদর্শন করা। মূল প্রাসাদের অল্প সময় পরেই এটি নির্মাণ করা হয়। মন্দিরটির নির্মাণ কাজ ১৭৮৩ সালে সম্পন্ন হয়। এ রাজকীয় উপসানালয়টি প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছে।
এমারেল্ড বুদ্ধ মন্দিরের মিউজিয়ামটি ফ্রা থিনাঙ্গ মহা প্রসাত গ্রæপের বিপরীতে অবস্থিত। মিউজিয়ামের এক তলায় বিভিন্ন শিল্পকর্মের চিত্র প্রদর্শনী রয়েছে, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সভাগৃহটি সাদা হাতির অস্থির প্রদর্শন করা হয়। এই হাতিগুলোর গোলাপী রং এর কোমল চোখ ছিল।
এগুলোর রাজপদের এক অপরিহার্য প্রতীক ছিল ও তাদের সম্পদশালীনতা রাজার খ্যাতিকে প্রভাবিত করেছিল; যার যত সাদা হাতি তাঁর তত প্রতিপত্তি। এটাকে থাইল্যান্ডের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির হিসেবে দেখা হয়।
যদিও এটাকে এমারেল্ড বুদ্ধ মন্দির বা ওয়াত ফ্রা কায়েও হিসেবে উল্লেখ করা হয় কিন্তু এটা মন্দির নয়, বরং একটি চ্যাপেল। মন্দির ও চ্যাপেলের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো মন্দিরে ঐতিহ্যগতভাবেই ভিক্ষুদের বাসা থাকে। আর ওয়াত ফ্রা কায়েওতে এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নেই।
প্রকৃতপক্ষে এমারেল্ড বুদ্ধের মূর্তিটি যেখানে স্থাপন করা আছে, তার নিকটস্থ কোথাও পর্যটকদের যেতে দেওয়া হয় না। কেবল রাজা নিজেই সেখানে যেতে পারেন। বছর জুড়ে বুদ্ধটিকে ভিন্ন তিনটি মোড়ক দিয়ে সুরক্ষা করা হয়।
শীতকাল, গ্রীষ্মকাল ও বৃষ্টিকাল এ তিন মৌসুমে তিনটি মোড়ক দিয়ে আবৃত করা হয়। এ মোড়কে সংশ্লিষ্ট মৌসুমের চিত্র খচিত থাকে। বুদ্ধের কাপড় পরিবর্তন করা থাই সংস্কৃতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেবল রাজা নিজে এ কাপড় পরিবর্তনের কাজ করে থাকেন।
ড্রেস কোড বা পোশাক বিধি:
গ্র্যান্ড প্যালেসের পর্যটকদের জন্য একটি ব্যতিক্রমী অবশ্য পালনীয় বিষয় হলো সেখানকার যথাযথ কঠোর ড্রেস কোড মেনে চলা। অর্থাৎ কেউ চাইলেই যেকোন পোশাক পরিধান করে প্রাসাদে প্রবেশ করতে পারবেন না। গ্র্যান্ড প্যালেসে শার্ট, মিনি স্কার্ট, আঁটসাট পাজামা, যেকোন স্বচ্ছ পোশাক, স্যান্ডেল, সুইট সার্ট, সুইট প্যান্ট ও পাজামা পরে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
এমনকি আপনার কাছে যদি কাঁধ ঢেকে রাখার জন্য শাল থাকে তাহলেও হয়ত নিরাপত্তা প্রহরী আপনাকে বের করে দিতে পারে। এজন্য ঝামেলা এড়াতে যথাপোযুক্ত পোশাক পরিধান করা ও পানি সঙ্গে রাখা। নতুবা দর্শনার্থীদের প্রাসাদের গেটেই আটকে দেওয়া হবে।
এই গ্র্যান্ড প্যালেসটির মধ্যে প্রায় ৩৫ টি আকর্ষণ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকটি হল :
রাজ্যাভিষেকের পটমন্ডপ, রাজকীয় অলংকরণ ও মূদ্রা যাদুঘরে- মূদ্রা, রাজপোশাক, অলঙ্কারাদি, রাজ দরবারে ব্যবহৃত রাজকীয় অলংকরণ প্রদর্শিত হয়। ফ্রা থিনাঙ্গ আমারিন উইনিটচাই মাহাইসূর্য ফিমান হল এই ভবনটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইমারত। এই থাই শৈলীর সিংহাসন সভাগৃহটি বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য নির্মিত হয়েছিল।
গ্র্যান্ড প্যালেস ভবনের আরোও অন্যান্য কিছু আগ্রহদীপ্ত পরিদর্শনমূলক স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজ পরিবারের দপ্তর, সালা লূক খুন নাই, সালা সাহাথাই সামাখোম, সিওয়ালাই বাগিচা, হো শাস্ত্রখোম, হো সুলালাই ফিমান এবং হো ফ্রা দেট মোন্দিয়েন।
প্রাসাদ স্থানান্তরের ইতিহাস:
১৭৮২ সালের ৬ মে রাজা বুদ্ধ ইয়োদফা চুলালোকে (রামা ১) নানা কারণে রাজধানী থনবুড়ি থেকে ব্যাংককে স্থানান্তর করেন। থনবুড়ির রাজা তাকসিনের কাছ থেকে মুকুট জব্দ করে রাজা রামা ১ তার নতুন চক্রী রাজবংশের জন্য নতুন রাজধানীতে ভবন তৈরি করার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তাই থনবুড়ি শহর থেকে রাজ প্রাসাদ চাও ফ্রা নদীর পশ্চিম পাশে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এর পূর্ব পাশেই অবস্থিত ব্যাংকক।
প্রাসাদ তৈরির উপকরণ:
আজ প্রাসাদ প্রাঙ্গণ যতটুকু এলাকা জুড়ে দেখা যায় নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার সময় এর চেয়ে তা অনেক ছোট ছিল। পরবর্তীতে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে অতিরিক্ত ভবনগুলো বিভিন্ন রাজা উত্তরাধিকার সূত্রে নির্মাণ করেছেন। প্রত্যেক রাজাই গ্র্যান্ড প্যালেসে নিজ কৃতত্ব যুক্ত করার বিষয়ে ছিলেন আগ্রহী।
মূলত উপযুক্ত উপকরণ স্বল্পতার কারণে প্রাসাদটি প্রাথমিকভাবে সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। নির্মাণ শুরুর মাত্র পাঁচ সপ্তাহ পর প্রাসাদটি রাজা রামার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রস্তুত করা হয়। ১৭৮২ সালের ১৩ জুন প্রাসাদটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাসভবন হিসেবে গ্রহণ করেন রাজা প্রথম রামা।
রাজা পরবর্তী বছরগুলোতে ধীরে ধীরে কাঠের অবকাঠামো বিলাসবহুল উপকরণ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেন এবং তা রাজাদের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন। প্রতিটি নতুন রাজা প্রাসাদটিতে তাদের নিজ নিজ অবদানকে জুড়ে দিয়েছেন। আবার অনেকে নতুন নতুন ভবন যুক্ত বা আরও আকর্ষণীয় উপকরণ দিয়ে বিদ্যমান ভবনগুলোকে আরও দৃষ্টিনন্দন করেছেন।
উপকরণ সংগ্রহ:
পর্যাপ্ত উপকরণ ও তহবিলের অভাবে প্রাসাদটি প্রাথমিকভাবে সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। ব্যাংকক থেকে ৮১ কিঃমিঃ দুরে একদা শ্যামদেশের রাজধানী অযোধ্যা নগরীতে রয়েছে আরেক রাজবাড়ি। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ওই স্রোতস্বীনি ছাও ফ্রায়া নদী। এ নদীর ভাটিতে গ্র্যান্ড প্যালেস আর উজানের দিকে শ্যামদেশের ওই পুরোনো রাজধানী। ১৭৬৭ সালে বার্মা ও শ্যাম দেশের মধ্যে যুদ্ধে শহরটি ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রাসাদ নির্মাণে বেশি বেশি উপকরণ সংগ্রহে রাজা প্রথম রামা তার লোকজনকে উজানের এ পুরনো রাজধানী শহর অযোধ্যা যাওয়ার নির্দেশ দেন। তারা সেখানে গিয়ে পুরনো রাজবাড়ির সব ইট খুলতে ও সরাতে থাকেন। তবে সেখানকার মন্দির থেকে কোন ইট সরানো হয়নি।
তারা শহরটির কেল্লা ও প্রাচীর থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে। অবশেষে রাজার লোকজন পুরনো রাজ প্রাসাদটি সম্পূর্ণ সমান করে ফেলে। পরে রণতরী ভরে ইট ও অন্যান্য উপকরণ চাও ফ্রা নদী দিয়ে বহন করে নিয়ে আসা হয়।
পরে এসব ইট দিয়ে ব্যাংককের প্রাচীর ও প্রাসাদ নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রথম রাজা রামার আমলে গ্র্যান্ড প্যালেসের প্রাথমিক নির্মাণের বেশিরভাগ নির্মাণ করা হয়। জোরপূর্বক বা বিনা মজুরির শ্রম দিয়ে তৈরি করা হয় এটি।
প্রাসাদের আনুষ্ঠানিক হলের চূড়ান্ত নির্মাণ সম্পন্ন হলে রাজা ১৭৮৫ সালে ঐতিহ্যগত অভিষেক অনুষ্ঠান গ্রহণ করেন। গ্র্যান্ড প্যালেসের নকশা অনেকটা অযোধ্যার রাজ প্রাসাদের মত করা হয়। বিভিন্ন পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত, প্রাচীর, গেট ও কেল্লার গড়ে তোলা হয়।
গ্র্যান্ড প্যালেস পরিদর্শন:
ব্যাংককের কেন্দ্রে অবস্থিত গ্র্যান্ড প্যালেস শিয়ামের রাজাদের সরকারি বাসভবন হিসেবে পরিষেবিত হতো। গ্র্যান্ড প্যালেস থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নিকটবর্তী বিমানবন্দরটি হলো ডোন মূয়েয়াং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। গ্র্যান্ড প্যালেস পরিভ্রমণের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায় হল ভায়া ওয়্যাটার ট্যাক্সি।
গ্র্যান্ড প্যালেস, বছরের ৩৬৫ দিনই খোলা থাকে। তবে নভেম্বর থেকে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত এখানকার আবহাওয়া মনোরম থাকায় এই সময়ই হল গ্র্যান্ড প্যালেস পরিদর্শনের সেরা সময়। প্রাসাদটির চারদিক ঘুরতে চার ঘণ্টার বেশি সময় নেয়া উচিত নয়। ভ্রমণের সবচেয়ে ভাল সময় ভোর বেলা। এসময় মূল ধারার পর্যটকরা সেখানে গিয়ে পৌঁছে না। দিনের একেবারে শুরুর দিকে তাপমাত্রা অধিক সহনীয় থাকে।
গ্র্যান্ড প্যালেস দর্শনের সময়:
প্রাসাদটি প্রতিদিন সকাল ৮:৩০ টা থেকে বিকেল ৩:৩০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এই সময়ে গেটেই টিকেট বিক্রি হয়। একটি প্রবেশ টিকিটের মূল্য ৫০০ থাই বাথ। কোনো দর্শনার্থীর হোটেলটি যদি নদীর তীরবর্তী হয়, তাহলে খুব সহজেই ওয়াটার ট্যাক্সি ধরে সোজা প্রাসাদে চলে আসতে পারবেন। কিন্তু গণপরিবহন যোগে প্রাসাদটিতে যাওয়া বেশ কঠিন।
পর্যটক ফাঁদ:
ব্যাংককের গ্র্যান্ড প্যালেস এলাকাটি পর্যটক ফাঁদ হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছে। অসাধু চক্র পর্যটকদের এ এলাকার প্রতি আকর্ষণকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায়। এখানে এসব অসাধু চক্র পর্যটকদের বিশ^াসযোগ্য বন্ধু সেজে পর্যটকদেও সঙ্গে মেশার চেষ্টা করবে। পর্যটকদের ওই এলাকায় কম ভাড়ায় ভাল ভাল জায়গা ঘুরিয়ে দেখানোর প্রস্তাব দেবে। কিন্তুপর্যটকদের তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে।
আবার যদি কেউ বলে গ্র্যান্ড প্যালেস বন্ধ আছে, তবে অন্যান্য কিছু জায়গা আছে যা থেকে আপনি আরও বেশি বিনোদন নিতে পারেন; সেখানে একই ধরনের সুন্দর মন্দির রয়েছে। তাহলে পর্যটকরা ন¤্রভাবে তার প্রস্তাব নাকচ করে দেবেন।
বর্তমান রাজ প্রাসাদ (ভুমিবল):
থাইল্যান্ডের সদ্য প্রয়াত রাজা ভুমিবল (নবম রামা ) গ্র্যান্ড প্যালেসে কখনও বসবাস করেন নি। তিনি চিত্রলাদা রয়াল ভিল্লার দুসিত প্যালেসে বসবাস করতেন। শুধুমাত্র কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বা বিদেশি মেহমানদের অভ্যর্থনা ও ভোজসভার জন্য তিনি এই প্রাসাদ ব্যবহার করতেন। প্রতিবছর কয়েকটি রাজকীয় অনুষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি প্রাসাদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে, তাই এটা এখন পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য।
লেখক: মোহাম্মদ রবিউল্লাহ, সাংবাদিক ও অনুবাদক