থাইল্যান্ডের গর্ব ‘রয়েল বার্জ’ শোভাযাত্রা

সারি সারি নৌকা এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে চলছে, এটি রয়েল বার্জ বা রাজকীয় শোভাযাত্রা। কোনোটি দেখতে রাজহাঁসের মতো, আবার কোনোটা দেখতে ঈগলের মতো। দুই পাশে বৈঠা দিয়ে বেয়ে চলছেন হাজারো মাঝি-মাল্লা। ৫২টি বজরা নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর থাইল্যান্ডের চাও ফ্রেয়া নদীতে বিশাল এই নৌ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

দিনটি ছিল থাইল্যান্ডের রাজা মহা ভাজিরালংকর্নের ৭২তম জন্মদিন। রাজার জন্মদিন উদযাপনের অংশ হিসেবে রাজধানী ব্যাংককে নৌ শোভাযাত্রার আয়োজন করে থাই রয়েল নেভি। ঝলমলে রাজকীয় শোভাযাত্রা দেখতে বিকেলে হাজার হাজার মানুষ চাও ফ্রেয়ার দুই তীরে সমবেত হন।

৩ ঘণ্টাব্যাপী নৌ শোভাযাত্রাটি পরিচালনা করে থাই নৌবাহিনীর নাবিকরা। অলঙ্কৃত পোশাক পরিহিত আড়াই হাজার মাঝি-মাল্লা বৌদ্ধ পৌরাণিক দেবতা ওয়াট অরুনের মতো চিহ্ন সম্বলিত বজরাগুলোকে নদীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বেয়ে নিয়ে যায়।

হাজারো মাঝি-মাল্লার বৈঠা বাওয়ার এমন মনোরম দৃশ্য দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে। দুই তীরের ১৪টি স্থান থেকে এই আইকনিক দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ করে দেয় প্রশাসন।

আইডি কার্ড ও পাসপোর্ট দেখিয়ে এসব স্থান থেকে নৌ শোভাযাত্রা উপভোগ করেন আগতরা। এই উপলক্ষ্যে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত থাইল্যান্ডের গণপরিবহনের ভাড়াও ফ্রি করে দেওয়া হয়।

প্রাচীন রাজকীয় এই নৌ শোভাযাত্রায় অংশ নেন থাই রাজা মহা ভাজিরালংকর্ন, রানী সুথিদা, রাজকুমারী শিরিভানানওয়ারী নারীরতনা, রাজকুমার দীপাংকর্ন রাসমজোতিসহ রাজপরিবারের অন্য সদস্যরা। এই প্রাচীন অনুষ্ঠানকে থাই রাজপরিবারের ঐতিহ্যের প্রদর্শনী ও রাজতন্ত্রের প্রতি দেশবাসীর শ্রদ্ধা হিসেবে দেখা হয়।

শুরুর কথা

থাইল্যান্ডের রয়্যাল বজরা শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু হয় ১২৩৮-১৪৩৮ সালের মধ্যে। সুখোথাই রাজবংশ এই শোভাযাত্রা প্রচলন শুরু করেছিল। সুখোথাই রাজবংশের রাজা রাম খামহেংর রাজত্বকালে লয় ক্রাথং নামের অনুষ্ঠানে রাজকীয় বজরা শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

১২৯২ সালের রাম খামহেং শিলালিপির লেখা অনুযায়ী, রাজা রাম খামহেং লয় ক্রাথংয়ে সমবেত নারী-পুরুষদের খেলা দেখতেন ও তাদের গান শুনতেন। যখনই রাজকীয় বজরাটি রাজকীয় প্রাসাদের প্রেগ্রোডার সামনে নামত, তখন রাজকীয় কর্মকর্তারা আতশবাজি জ্বালিয়ে আনন্দে মেতে উঠতো।

এরপর রাজা প্রথম মহা থামমারাচার রাজত্বকালে তার বিশাল প্রাসাদের মাঝখানের হ্রদে বজরা ব্যবহার করে রাজকীয় অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। ৭০০ বছর ধরে এটি প্রচলিত রয়েছে থাইল্যান্ডে।

বৌদ্ধ ও হিন্দু পৌরাণিকে বর্ণনার মতো রাজহাঁস, ইগল ও সমুদ্রের প্রাণী সম্বলিত এই বজরাগুলোকে সাজানো হয়। ৫২টি সুসজ্জিত বজরা চাও ফ্রেয়ার পানিতে ভাসতে থাকে সারিবদ্ধভাবে।

এর মধ্যে একটিতে রাজা ও রানী বসেন। আরেকটিতে রাজকুমার ও রাজকুমারি বসে নদীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভ্রমণ করেন। প্রাচীন শোভাযাত্রার এই ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে বজরাগুলোকে সোনায় সজ্জিত করা হয়। সুসজ্জিত বজরাগুলো ২ সহস্রাধিক মাঝি-মাল্লার অংশগ্রহণে পানির ওপর ভাসতে থাকে। এই নৌ শোভাযাত্রা সত্যিই অসাধারণ। ব্যাপক আয়োজনের এই নৌ শোভাযাত্রা দেখে স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকরা বিস্মিত হয়।

রাজা ভূমিবল আদুলিয়াজ

থাইল্যান্ডের সবেচেয়ে জনপ্রিয় প্রয়াত রাজা ভূমিবল আদুলিয়াজ বেশ কয়েক দশক বিরতির পরে ১৯২০ সালে এই নৌ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানটি পুনরায় চালু করেন। ২০০৭ সালে রাজা ভূমিবলের ৮০তম জন্মদিন উদযাপনের জন্য নৌ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল।

২০০৮ সালে অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে থাইল্যান্ড। সে বছর দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ডুবে যায়। ফলে বাধ্য হয়েই বাতিল করতে হয় বিলাসী সব আয়োজন। এর পরের বছর ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে রাজা ভুমিবল অসুস্থ হওয়ার পর এই অনুষ্ঠানটি ধারাবাহিকতা হারায়।

১৯৪৬ সাল থেকে ৭০ বছর থাইল্যান্ডের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন রাজা ভূমিবল। তার সাত দশকের শাসনালে মোট ১৬ বার এই নৌ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর ৮৮ বছর বয়সে মারা যান ভূমিবল। তার মৃত্যুর পর থাইল্যান্ডের নতুন রাজা হিসেবে যুবরাজ মহা ভাজিরালংকর্নের নাম ঘোষণা করা হয়। চকরি রাজবংশের দশম রাজা হয়ে রাজসিংহাসনে বসেন তিনি। ৬৪ বছর বয়সী মহা ভাজিরালংকর্ন ভূমিবলের একমাত্র ছেলে।

তথ্যসূত্র: ব্যাংকক পোস্ট, থাই এক্সামিনার,আরব নিউজ ও ভয়েস অব আমেরিকা