সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীটা একদিকে যেমন রহস্যময় অন্যদিকে অপরুপ সৌন্দর্য্যে ঘেরা। পৃথিবীর তেমন এক বিস্ময়কর ও বৈচিত্রপূর্ণ নাম আটলান্টিক মহাসাগর।
আয়তনে ও গভীরতায় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এটি। এর আয়তন প্রায় ১০ কোটি ৬৪ লাখ ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার।
পৃথিবীর ৪ টি মহাদেশ এ মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত। পশ্চিমে উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই আমেরিকা মহাদেশ এবং পূর্বে ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশ।
মিশর, স্পেন, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাসহ বিশ্বের ১৩৩ টি দেশ এই মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত।
অন্যান্য মহাসাগরের পানি নীল দেখালেও এর পানি দেখতে অনেকটাই সবুজ বর্ণের। আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে মৃত জলজ উদ্ভিদ থেকে এক ধরণের হলুদ রঙের রঞ্জক পদার্থ নিঃসরিত হয়ে পানির রং সবুজাভ করে তোলে।
এছাড়া আটলান্টিকের পানিতে সূর্যের সাতটি রঙের মধ্যে সবুজ রঙটি বেশি বিচ্ছুরিত হয়। ফলে এর পানির রং নীলের পরিবর্তে সবুজ দেখায়।
এর পানি অত্যন্ত লবণাক্ত ও পানির পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা মাইনাস ৪ ডিগ্রি থেকে ৩০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ওঠানামা করে।
পৃথিবীর প্রায় ৫ ভাগের এক ভাগ অংশ এবং পৃথিবীর মোট জলভাগের প্রায় ২৯ ভাগ এলাকা এ মহাসাগরের দখলে। এর গড় গভীরতা ৩ হাজার ৭৩০ মিটার।
এ মহাসাগরের সর্বাধিক গভীরতম খাদ পুয়ের্তো রিকো, যার গভীরতা প্রায় ৮ হাজার ৩৭৬ মিটার। এছাড়াও ছোট বড় আরো ৪৩ টি সাগর রয়েছে এ মহাসাগরে।
রহস্যময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এ মহাসাগরের বুকে অবস্থিত। কথিত আছে, এখানে কোন জাহাজ ঢুকে পড়লে তা আর ফিরে আসে না, এমনকি উপর দিয়ে বিমানও চলাচল করতে পারে না।
যদিও এর কোন বিজ্ঞান সম্মত যুক্তি বা প্রমাণ নেই। এ ট্রায়াঙ্গলের অবস্থান বারমুডা, পুয়ের্তো রিকো ও আমেরিকার মিয়ামি সৈকতের মাঝামাঝি স্থানে।
আটলান্টিকের ১৫ মিটার তলদেশে ৩০০ ভাস্কর্য স্থাপন করে যাদুঘর তৈরি করেছে স্পেন। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের সাগরতলের এ ভাস্কর্য সাগরের পানির বা জীব বৈচিত্র্যের কোনও ক্ষতি হবে না।
এগুলো ৩০০ বছর পর্যন্ত টিকবে বলে দাবি করা হচ্ছে। সারা বছরই লাখ লাখ পর্যটকের আনাগোনা থাকে পানির নিচের ব্যতিক্রমী এই যাদুঘর দেখতে।
আরো পড়ুন: হিমশীতল উত্তর মহাসাগর এর জীবনযাপন
জগত বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ ১৯১২ এ মহাসাগরে ডুবে যায়, যা তৎকালীন সময়ের পৃথিবীর সব চেয়ে বড় ও বিলাসবহুল জাহাজ ছিল। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বিখ্যাত চলচ্চিত্র টাইটানিকের নির্মাণ করেছিলেন পরিচালক জেমস ক্যামেরুন।
চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন হলিউড অভিনেতা লিওনার্ডো ডিক্যাপ্রিও ও কেট উইন্সলেট। যে সিনেমার উপজীব্য মৃত্যু আর বিচ্ছেদ। গোটা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করেছিল টাইটাইনিক সিনেমাটি।
আটলান্টিক মহাসাগর উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে বিভক্ত। শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির অন্যতম উৎস হিসেবে পরিচিত এই মহাসাগর।
গ্রীষ্মকালে উত্তর আটলান্টিকে ঘূর্ণিঝড় হারিকেন আর উত্তর আটলান্টিকে সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড় দেখা যায় সেপ্টেম্বর মাসে।
বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৪০ ভাগ এ মহাসাগরের জলপথে হয়। সমুদ্রপথে ইউরোপের সাথে আমেরিকার, এশিয়া ও আফ্রিকার সাথে আমেরিকার বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এটি।
জার্মানির কিয়েল খাল, ডেনমার্ক ও সুইডেন এর মধ্যবর্তী ওরেসুন্ড প্রণালী, তুরস্কের বসফরাস প্রণালী, স্পেন ও মরক্কোর মধ্যবর্তী জিব্রাল্টার প্রণালী এবং কানাডার সেন্ট লরেন্স সমুদ্রপথ আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশের কৌশলগত জলপথ।
আলেকজান্দ্রিয়া, বার্সেলোনা, কোপেনহেগেন, হামবুর্গ, লন্ডন, লে হার্ভে, লিসবন, অসলো, রটারডার্ম, সেন্ট পিটার্সবার্গ, মন্ট্রিল, নিউইয়র্ক , নিউ অর্লিন্স, রিও ডি জেনেরিও, বুয়েন্স আয়ার্স এর মতো ব্যস্ততম বন্দর ও পোতাশ্রয় আটলান্টিকের তীরে অবস্থিত।
আটলান্টিকে বাণিজ্যিক গুরুত্বের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে জলদস্যুতা আটলান্টিকের সমুদ্রপথকে বিপদজনক করে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলোর জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে ওঠে সোমালিয়ার জলদস্যুরা।
আটলান্টিক মহাসাগরে বেশকিছু সাগর ও উপসাগর রয়েছে। এদের মধ্যে বাল্টিক সাগর, কৃষ্ণসাগর, উত্তর সাগর, নরওয়েজিয়ান সাগর, ভূমধ্যসাগর, ক্যারিবীয় সাগর এবং মেক্সিকো উপসাগর অন্যতম।
আমাজন নদী, মিসিসিপি নদী, রিও দে প্লাতা নদী, নাইজার নদী, কঙ্গো নদী ও রাইন নদীর মতো প্রধান প্রধান নদীগুলোর পানি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই মহাসাগরে পতিত হয়।
পৃথিবীর সব থেকে বড় দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড এ মহাসাগরে অবস্থিত। গ্রীনল্যান্ডের আয়তন বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ১৫ গুণ বড়। ডেনমার্ক, ম্যাজালান, ফ্লোরিডা ও ডোভার এ মহাসাগরের অন্যতম প্রণালী।
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যবর্তী ডোভার প্রণালী বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম সমুদ্র প্রণালী। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ বাণিজ্যিক জাহাজ যাতায়াত করে।
সময় ও স্থানভেদে আটলান্টিকের পানি বরফে পরিণত হয়। অক্টোবর থেকে জুন মাস পর্যন্ত এ মহাসাগরের ল্যাব্রাডর সাগর, বাল্টিক সাগর ও ডেনমার্ক প্রণালী বরফে ঢাকা থাকে।
সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী সিলস এবং তিমির বিপুল আনাগোনা দেখা যায় আটলান্টিকের জলরাশিতে।
আরো পড়ুন: বরফাবৃত দক্ষিণ মহাসাগর জীব বৈচিত্র
আটলান্টিক মহাসাগরে প্রাকৃতিক গ্যাস, অপরিশোধিত তেল, মূল্যবান পাথর, বালু, পেট্রোলিয়ামের মতো খনিজ সম্পদের বিপুল ভান্ডার রয়েছে। প্রাকৃতিক এই সম্পদ তীরবর্তী দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।
মজার বিষয় হচ্ছে আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে মাইলের পর মাইলজুড়ে স্বর্ণের খনিও আছে। তবে তা উত্তোলনের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি।
মৎস্য সম্পদের জন্যও এর বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের দিক থেকে আটলান্টিকের অবস্থান দ্বিতীয়।
রেড স্ন্যাপার, এনচোবি, ব্লু ওয়াইটিং, টারপোন, টোনা, হেরিং ফিশসহ নানান প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় আটলান্টিকের পানিতে। বিশ্বে মোট মাছের প্রায় ২৫ শতাংশেএ মহাসাগর যোগান দেয়।
আটলান্টিক মহাসাগরের অর্থ অ্যাটলাসের সমুদ্র। গ্রিক পুরাণে একজন আদি দেবতা অ্যাটলাস বা আতলাস ছিলেন টাইটান ইয়াপেতুস ও ওশেনিড ক্লাইমেনের সন্তান।
তিনি ছিলেন প্রমিথিয়াস, এপিমিথিয়াস ও মেনিতিয়াসের ভাই। প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বাস করত অ্যাটলাস বা আতলাস স্বর্গ, আকাশ ও পৃথিবীকে তার মাথার উপরে ধরে রেখেছে।
নেভিগেশন ও জ্যোতিবিজ্ঞানের গ্রীক দেবতা অ্যাটলাসের নামানুসারে আটলান্টিস নামের উৎপত্তি এবং যুগ যুগ ধরে চলা এই নামই শেষ পর্যন্ত রুপ নেয় আটলান্টিক নামে। আটলান্টিক মহাসাগর দেখতে অনেকটা ইংরেজি এস(S) অক্ষরের মতো।
পরিতাপের বিষয় পৃথিবী যত আধুনিক হচ্ছে এ মহাসাগর তত দূষিত হচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরের মতই আটলান্টিক মহাসাগরও দিন দিন দূষিত হয়ে পড়ছে।
অধিক পরিমাণে জাহাজ চলাচলের কারণে আটলান্টিকের পানিতে মিশছে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য, যা এর পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া শিল্পায়ন ও প্লাস্টিকের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের কল-কারখানার বর্জ্য ও যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, মাছ ধরার জালও নদীগুলোর মাধ্যমে এ মহাসাগরে পতিত হচ্ছে তাতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দূষণের মাত্রা। তাতে হুমকিতে পড়ছে জলজপ্রাণি।