
ভারত আমেরিকা চীন কাকে দরকার বাংলাদেশের?
বিশ্ব জুড়েই চলছে এক ধরনের অস্থিরতা। সামাজিক অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতি কোন অঙ্গনই এর নেতিবাচক প্রভাব মুক্ত নয়।
একদিকে করোনা ভাইরাসের ধকল অন্যদিকে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ গোটা বিশ্বের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে দিয়েছে।
এই মুহূর্তে বিশ্বের বড় বড় শক্তিধর দেশগুলো একে অপরকে পরাস্ত করতে এগোচ্ছে নানান কৌশলে। আর প্রতিটি শক্তিশালী দেশই চাচ্ছে অপেক্ষাকৃত ছোট ও কম শক্তিধর দেশগুলো এই লড়াইয়ে তাদের সঙ্গী হোক।
এ লড়াইয়ের সঙ্গী হওয়ার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে ছোট দেশগুলোও নানান কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। সেই কৌশলাশ্রয়ী দেশগুলোর একটি হচ্ছে বাংলাদেশ।
ভারত চীন আমেরিকার মতো শক্তিধর দেশগুলো এখন বাংলাদেশকে কাছে টানতে হাত বাড়িয়ে রেখেছে । এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে আমেরিকাকে পাশে পেয়েছে ভারত ৷ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে আমেরিকাও চাইছে চীনবিরোধী অবস্থানে থাকুক বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় সহযোগী চীন। চীন বাংলাদেশকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়ে রেখেছে, যা প্রয়োজন মতো ব্যবহার করছে বাংলাদেশ।
এছাড়া আরও ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়ার অঙ্গীকারও করেছে চীন। এ ক্ষেত্রে চীনবিরোধী অবস্থানে যাওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব না।
অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও আমেরিকার মধ্যে একটি কৌশলগত জোট গড়ে উঠেছে যার নাম কোয়াড। কোয়াডের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে যথেষ্ট চাপের মুখে রেখেছে ওয়াশিংটন।
তবে চীন কোয়াডকে এশিয়ার ন্যাটো বলে উল্লেখ করেছে। এমনকী এখানে যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না বলেও মনে করে দেশটি।
এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা না, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা ও নেপালও এই সংকটে আছে ৷
বাংলাদেশ কোয়াডে যুক্ত না হলেও মার্কিন প্রভাব এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা আমেরিকাসহ পশ্চিমারা।
এছাড়াও অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় অংশীদারিত্ব রয়েছে আমেরিকার সঙ্গে। বাংলাদেশের ওপর নানান ধরনের চাপ সৃষ্টির ক্ষমতাও রয়েছে দেশটির।
কোয়াডের আরেক সদস্য ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশি দেশ হওয়ায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াও দুই দেশের জনগণের মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতিগত গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
এক্ষেত্রে কোন পক্ষকে একেবারে দূরে সরিয়ে অন্য পক্ষকে কাছে টানাও সহজ নয় ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে। সবাইকেই সমানভাবে সন্তুষ্ট রাখতে হচ্ছে ঢাকাকে।
এ পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের জন্য ‘উভয় সংকট’ বলছেন কূটনীতি বিশ্লেষকরা ৷ তাদের দাবি, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নকে গতিশীল রাখা আর রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের বিকল্প নেই বাংলাদেশের সামনে৷
আর বিশ্ব রাজনীতি, পশ্চিমা বাণিজ্য সব দিক মাথায় রেখে আমেরিকা ও প্রতিবেশি দেশ ভারতকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ারও পথ নেই বাংলাদেশের৷
এমন বাস্তবতায় কূটনীতিকরা বলছেন, ভারসাম্য সুরক্ষা করাটা হবে সবচেয়ে জরুরি৷ কোনো বলয়ের মধ্যে আটকে না থেকে, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের যে কৌশলগত সুবিধা বাংলাদেশের হাতে আছে, সেটাকে পুঁজি বানাতে হবে, করতে হবে ‘বার্গেইনিং টুল৷’
কেননা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি হচ্ছে, সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই নীতিতেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে গেছেন।
আর এ ক্ষেত্রে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছে বর্তমান সরকার। শুধু তাই নয়, অনেকে বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুকৌশলে শক্তিধর দেশগুলোকেই বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী করে রেখেছে।
সম্পর্কের এমন ভারসাম্য এখন পর্যন্ত খুব কম দেশই বজায় রাখতে পারছে। আর এটিই বাংলাদেশের জন্য সঠিক কক্ষপথ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি বিশেষজ্ঞরা।
সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরীতা নয় এই নীতি মেনে চললে আগামীতেও বড় বড় শক্তিধর রাষ্ট্র গুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব বলেও মনে করেন রাষ্ট্র ও সরকার বিশেষজ্ঞরা।
লেখক: সাইফ নাসির, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।