যে সীমান্ত রেখা দুটি দেশ বা জাতিকে বিভক্ত করে তার পেছনে প্রায়ই চমকপ্রদ কোনো গল্প থাকে। ঐতিহাসিক চুক্তি কিংবা ভৌগোলিক কারণ, যুদ্ধ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কিংবা কখনও নিছক সিদ্ধান্তহীনতা— এমন নানা কারণ থাকে সীমান্ত রেখার অন্তরালে। আজ আমরা বিশ্বের এমন কিছু সীমান্ত নিয়ে আলোচনা করব যেগুলো আমাদের চিরচেনা কাঁটাতারের সীমান্তের মতো না। বিচিত্র এসব সীমানার অস্তিত্বের পিছনে আছে মজার কিছু ঘটনা।
রোম-ভ্যাটিকানের অদৃশ্য সীমানা
আমাদের তালিকার প্রথম অদ্ভুত সীমানা হলো ভ্যাটিকান সিটি ও রোমের অদৃশ্য সীমানা। ভ্যাটিকান সিটি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট দেশ। সমগ্র দেশটি মাত্র ১২১ একর (৪৯ হেক্টর) বিস্তৃত।
ভ্যাটিকান সিটি সম্পূর্ণরূপে ইতালির রাজধানী রোম দ্বারা বেষ্টিত। সেখানে যেতে হলে আপনাকে রোম শহরের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। কিন্তু ভ্যাটিকান সিটির স্পষ্ট কোনো সীমানা নেই। এই ‘ওপেন বর্ডারে’র জন্যই কিনা ভ্যাটিকান সিটিকে শেনজেনভুক্ত এলাকার অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
স্পেন-পর্তুগাল ক্রস-বর্ডার জিপলাইন
স্থলপথে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত পার হয়েছেন কখনো? তাহলে সীমান্ত পার হওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা বুঝতে পারবেন। কিন্তু মাঝে মাঝে সীমান্ত অতিক্রম করা মজাদারও হতে পারে। স্পেনের সানলুকার দে গুয়াডিয়ানাতে পর্তুগালের সীমানা লিমিটে জিরোতে একটি আনন্দদায়ক সীমান্ত পারাপারের ব্যবস্থা আছে।
এখানে আপনি বিশ্বের একমাত্র ক্রস-বর্ডার জিপলাইন পাবেন। শূন্যে ঝুলে আপনি ২৩৬২ ফুট বা ৭২০ মিটার দীর্ঘ জিপলাইন ব্যবহার করে ৮০ কিলোমিটার বেগে গুয়াদিয়ানা নদী পার হয়ে পর্তুগালে যেতে পারবেন। জিপলাইনের মাধ্যমে স্পেন ও পর্তুগালের মধ্যে সীমানা অতিক্রম করতে মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় লাগে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, আপনি জিপলাইন ব্যবহার করে পর্তুগাল থেকে স্পেনে ফিরতে পারবেন না।
বেলজিয়াম-নেদারল্যান্ডসের ছিটমহল জটিলতা
ছিটমহল হলো একটি এলাকা যা চারদিক থেকে অন্য একটি দেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। নিজ দেশের অন্য অংশে যেতে হলেও ছিটমহলের বাসিন্দাদের চারদিকে ঘিরে থাকা দেশটি অতিক্রম করে তবেই যেতে হয়।
তবে বেলজিয়াম-নেদারল্যান্ডস সীমানার মতো অদ্ভুত জটিলতা সম্ভবত আর কোনো দেশে নেই। এই দুই দেশের সীমান্তের ‘বারলে’ শহরে অনেকগুলো ছিটমহল বা এক্সক্লেভ রয়েছে। এখানকার কিছু ঘরবাড়ি আছে যার শয়নকক্ষ এক দেশে, শৌচাগার অন্য দেশে।
অদ্ভুত এই পরিস্থিতিতে দুই দেশ মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে সীমানার দিকে বাড়ির সদর দরজা থাকবে বাড়িটি ওই দেশের। কিন্তু তাতেও সমস্যা পুরোপুরি মেটেনি। কারণ কিছু কিছু বাড়ির প্রধান দরজা আবার সীমানার ঠিক মাঝখানে। তাই আজও বেলজিয়াম-নেদারল্যান্ড সীমানা জটিলতার কোনো সমাধান হয়নি।
সুইজারল্যান্ড-ফ্রান্সে সীমানায় বিভক্ত হোটেল
সুইজারল্যান্ড-ফ্রান্স সীমান্তে আছে হোটেল আরবেজ। এটি লা কিউর এলাকার একটি হোটেল, দুই দেশেই পড়েছে। ১৮৬২ সাল পর্যন্ত গ্রামটি সম্পূর্ণরূপে ফ্রান্সের অংশ ছিল। ভ্যালি ডেস ড্যাপেসের একটি সীমান্ত বিরোধের কারণে লা কিউরের কিছু অংশ সুইজারল্যান্ডের অধীনে চলে যায়।
হোটেল আরবেজের বিভিন্ন কক্ষ, খাবার ঘর এবং রান্নাঘর দুই দেশের সীমানা দ্বারা বিভক্ত। চমৎকারভাবে সাজানো হোটেলটির একটি বেডরুম ফ্রান্সে, তো বাথরুম সুইজারল্যান্ডে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, হোটেলের হানিমুন স্যুটের মাস্টার বেডের একটি অংশ ফ্রান্স, বাকি অংশ সুইজারল্যান্ডে পড়েছে।
স্লোভাকিয়া-অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ত্রিদেশীয় পিকনিক টেবিল
হাঙ্গেরির ভাস্কর্য পার্কটি স্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরির সীমান্তে অবস্থিত। একটি পিকনিক টেবিল এই অনন্য পয়েন্টটিকে চিহ্নিত করে। ওই পিকনিক টেবিলে বসে আপনি একই সাথে তিনটি ভিন্ন দেশে আপনার দুপুরের খাবার খেতে পারেন।
যদিও সীমানা প্রাচীর এবং চেকপয়েন্টগুলো বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে বিভাজনের কথা মনে করিয়ে দেয়, তারপরও এই জাতীয় স্থানগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মানুষ একে অপরের থেকে বেশি আলাদা নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার ‘স্ল্যাশ’
আমাদের তালিকার চূড়ান্ত অদ্ভুত সীমানা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মাঝের আন্তর্জাতিক সীমানা। এই সীমানা অনেক কারণে বিখ্যাত। প্রথমত, এটি বিশ্বের দীর্ঘতম সীমান্ত। এটি মেইন থেকে আলাস্কা পর্যন্ত ভূমি, সমুদ্র এবং মরুভূমিকে ঘিরে ৮৮৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্তের ‘দ্য স্ল্যাশ’ নামে একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সীমানাটি দৃশ্যমান করতে এর বড় একটা অংশের বন উজাড় করা হয়েছে। আনুমানিক ২০ ফুট (৬ মিটার) চওড়া এবং প্রায় ২১৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সীমানা ‘স্ল্যাশ’ পাহাড়ের ধার, বন, এমনকি বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলি জুড়ে বিস্তৃত।