
পুত্র বুলবুলের মৃত্যু ও নজরুলের বেদনা
জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখনী পড়ে সবাই মন মুগ্ধ হয়। বাল্যকাল থেকেই দুঃখ আর কষ্টের মধ্য দিয়ে তাকে জীবন যাপন করতে হয়েছে।
তার দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল ছিল অনেক আদরের। অসামান্য মেধাবী বুলবুলকে সকলেই নজরুলের যোগ্য উত্তরসূরি মনে করতেন। কবি তাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন।
ছোট বেলায়, কবি নজরুল, তার ছেলেকে একটা গজল শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সুমধুর সুরে সেটি বলতেন ছোট্ট বুলবুল। পুত্রের মধুর কণ্ঠে গজল শুনে মুগ্ধ হয়ে যেতেন কাজী নজরুল।
তবে কবি নজরুলের এই পরম প্রিয় পুত্র সন্তান মাত্র সাড়ে ৪ বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে ওপাড়ে চলে যায়।
এরপর থেকেই কবি শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হতে থাকেন। বন্ধুদের আড্ডা মাতিয়ে রাখা সদা চঞ্চল কবি একেবারেই বিমর্ষ থাকেন। বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট বাসা বাঁধতে শুরু করে কবির।
দুরারোগ্য ব্যাধি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার আগপর্যন্ত কবি নজরুলের সেই বিমর্ষতা দূর হয়নি। এতটাই পুত্র শোকে বিহ্বল ছিলেন যে কোন অবস্থাতেই তাকে পরিবর্তন করা যায়নি।

কবির প্রাণ প্রিয় সেই পুত্র বুলবুলকে নিয়ে নজরুলের দুটো খুবই বেদনাদায়ক কাহিনী আছে। যা জানার পর পরবর্তীতে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। তা হল-
কবির চার বছরের শিশু বুলবুল যে রাত্রে মৃত্যুবরণ করেছিল, সে রাতে কবির কাছে কোন টাকা পয়সা গহনা অলংকার কিছুই ছিল না। পকেট ছিল একেবারেই শূন্য।
মৃত পুত্র সন্তানের কাফন, দাফন, গাড়িতে করে দেহ নেওয়া ও গোরস্থানে জমি কেনার জন্য দেড় শত টাকার প্রয়োজন ছিল। ওই সময়ের দেড় শত টাকা মানে অনেক টাকা। এতো অর্থ কোথায় পাবেন কবি।
বিভিন্ন লাইব্রেরিতে লোক পাঠানো হলেও টাকার বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয় না। কেবল মাত্র ডি. এম লাইব্রেরি পঁয়তিরিশ টাকা দিয়ে ছিল। এখনো আরো অনেক টাকার প্রয়োজন।
ঘরে মৃত দেহ রেখে কবি এক প্রকাশকের দ্বারস্থ হলেন পাওনা টাকা নিতে। তবে প্রকাশক টাকা দিতে রাজি হলেও জুড়ে দিলেন শর্ত।
ওই প্রকাশকের শর্ত হচ্ছে এই মুহূর্তে এই মুহূর্তেই কবিতা লিখে দিতে হবে নজরুলকে। তারপর টাকা দেবেন তিনি।
কবি মনের নীরব কান্না ও যতনা লিখে দিলেন কবিতায়…
“ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে
আমার গানের বুলবুলি
করুন চোখে চেয়ে আছে
সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি”
কবি এভাবে পুত্র সন্তান বুলবুলকে হারিয়ে বুকে গভীর শোক লালন করে তার দিন অতিবাহিত করতে শুরু করলেন।
পঞ্চানন ঘোষাল তখন কলকাতার তরুণ পুলিশ অফিসার। কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন। প্রায়ই কবির সাথে খোশ গল্পে মেতে উঠতেন।

একবার কবির বাসায় তল্লাশির আদেশ আসলো উপর মহল থেকে। এই পুলিশ অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হল কবি নজরুলের বাসায় তল্লাশি টিমে থাকার জন্য।
গোয়েন্দারা পঞ্চানন ঘোষালকে নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল কবি নজরুলের ঘরে। কাজী নজরুল দরজা খুলে দিলেন।
আইনের বিধান অনুযায়ী এই তরুণ অফিসার ও কবি নজরুল উভয়ই পরস্পরকে না চেনার অভিনয় করলেন। গোয়েন্দা পুলিশের দল কবির ঘরে সবকিছু তছনছ করে তল্লাশি করছে।
কবিও তল্লাশি করতে আসা গোয়েন্দা পুলিশকে কোনো রকম বাধা প্রদান না করে সহায়তা করেন। তাদেরকে ঘরের মধ্যে থাকা সব বাক্স একে একে খুলে দেখাতে থাকেন।
হঠাৎ ঘরের কোণায় পরম যত্ন উঠিয়ে রাখা একটি বাক্সে নজর যায় ওই তল্লাশি টিমের সদস্যদের। তারা সেটি খুলে দেখতে চাইলে কবি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, না না, ওটাতে হাত দেবেন না যেন।
কবির বিচলিত মুখভঙ্গি দেখে পুলিশদের সন্দেহ আরো তীব্র হয়। তাদের একজন সজোরে সেটি খুলতেই সেই বাক্সটি থেকে ঝরে পড়ল কিছু খেলনা আর ছোট ছোট জামা কাপড়সহ বাচ্চাদের অন্যান্য সামগ্রী।

এভাবে সেগুলো আছড়ে মাটিতে পড়তে দেখে কবির দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে অশ্রু বারি ঝড়তে থাকে। ঝরঝর করে তিনি কেঁদে দিলেন সবার সামনেই। এমন সুকঠিন মুখখানা ব্যাথা বেদনায় কালো হয়ে আসে।
এ খেলনা ও ব্যবহার্য সামগ্রীগুলো ছিল কবির আদরের পুত্র সন্তান ছোট বুলবুলের। তার মৃত্যুর পর এসব বুকে জড়িয়ে কবি সান্তনা খুঁজে পেতেন, আদর আর চুমো পৌঁছে দিতেন বুলবুলের দুই গালে ও কপালে।
পুলিশ অফিসার পঞ্চানন ঘোষাল তার এক লেখনীতে নিজেকে অত্যন্ত ব্যর্থ ও লজ্জিত উল্লেখ করে নিজেকে অপরাধী আখ্যা দেন।
তিনি লিখেছেন, “এরপর কত মানুষের কত ঘর সার্চ করেছি তবে, সেদিনের মতো এমন কষ্ট আর কোথাও পাইনি।”
প্রত্যেকটা সন্তানের প্রতি বাবার পরম স্নেহ ও ভালোবাসা থাকে। বাবা জীবিত থাকতে সন্তানের মৃত্যু দেখার যন্ত্রণা সহ্য করা খুবই কঠিন।