সম্প্রতি ফিলিস্তিনের শাক-সবজি, কাউন চালসহ ২১টি শস্যদানার নমুনা জমা পড়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ বীজ ভান্ডার বা গ্লোবাল সিড ভল্টে। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত, ক্ষুধার্ত ও অনাহারে থাকা ফিলিস্তিনের শস্যদানা ওই ভল্টে যুক্ত হওয়ার পর এএফপি, রয়টার্সসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিশাল এই বীজ সংরক্ষণাগারটি।
ফিলিস্তিন ছাড়াও আরও ২০টি দেশের ২৩টি সংস্থার ৩০ হাজারেরও বেশি নমুনা নতুন করে ভল্টে জমা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিড ভল্টের অংশীদার ক্রপ ট্রাস্ট। সংরক্ষণাগারটির ইউরোপের দেশ নরওয়ের স্বালবার্ড দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত।
সুমেরু বৃত্তের কাছে ওই ভল্টের পোশাকি নাম ‘স্বালবার্ড গ্লোবাল সিড ভল্ট’, যেখানে রয়েছে ১৩ লাখ খাদ্যশস্যের বীজ। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে ভল্টটি। ভবিষ্যতে পৃথিবীতে খাদ্যসুরক্ষার অভাব দেখা দিলে এই ভল্টের দরজা খুলে দেওয়া হতে পারে। ভল্টে রাখা লাখো শস্যবীজের নমুনা থেকে তৈরি করা যাবে ফসল।
বিশ্বের নানা দেশ থেকে সংগৃহীত অসংখ্য বীজের ৯৯টি জিনব্যাংক, ৬ হাজার ১২০ প্রজাতির শস্যবীজ ও ৯ লাখ ৩০ হাজার শস্যদানা সংরক্ষিত রয়েছে এই ভল্টে। শুধুমাত্র চালের নমুনাই রয়েছে ২ লাখ প্রকারের। এই সংখ্যাটি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গত ৫০ বছরে বিশ্বজুড়েই কৃষিকাজের পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। প্রযুক্তির ওপর ভর করে ফসল ফলানোর কাজ শুরু হওয়ায় খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা আঘাত হেনেছে জীববৈচিত্রে। এসব কারণেই স্বালবার্ড দ্বীপপুঞ্জের পাহাড়ের কোলে এই ভল্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
খরা বা ফসলের রোগব্যাধির থেকেও উৎপাদনের ক্ষেত্রে থাবা বসিয়েছে একচেটিয়া পদ্ধতিতে কৃষিকাজ। আধুনিক সভ্যতার এই ‘অভিশাপেই’ ভবিষ্যতে খাদ্যসুরক্ষায় অভাব দেখা দিতে পারে। সেই শঙ্কা থেকেই শস্যদানার বীজ সংরক্ষণের পরিকল্পনা শুরু।
ভবিষ্যতে কখনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ বা অতিমারির প্রকোপে শস্যের প্রজাতিগুরো চিরতরে বিনষ্ট হয়ে গেলেও যাতে কৃষিকাজ চালিয়ে যাওয়া যায়। এই ভাবনা থেকেই এই সিড ভল্ট নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করাহ হয়।
এই সিড ভল্টের পরিকল্পনা শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। নরওয়ের লংগিয়ারবায়েন এলাকার অদূরে পরিত্যক্ত একটি কয়লাখনিতে। সেখানে নানা শস্যের হিমায়িত বীজের নমুনা সংরক্ষিত করতে শুরু করে নর্ডিক জিনব্যাংক, যা বর্তমানে নর্ডজেন নামে পরিচিত।
আশির দশকে এই ভল্ট নির্মাণের পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছে খাদ্যসুরক্ষা নিয়ে গবেষণাকারী আমেরিকার আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘গ্লোবাল ক্রপ ডাইভার্সিটি ট্রাস্ট’ বা ক্রপ ট্রাস্ট। এ বিষয়ে নরওয়ে সরকারের সাথে আলোচনা করে সংস্থাটি।
ভল্ট নির্মাণের আগে ২০০৪ সালে একটি সমীক্ষাও করা হয়। এর আগে ২০০১ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর পর স্বালবার্ডে সেটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় নরওয়ে সরকার।
চার বছর পর ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। তবে উদ্বোধনের আগের মাসেই সেখানে প্রথম শস্যদানার বীজ পৌঁছে যায়। এই ভল্টটির ভবন নির্মাণ করতে ৭২ কোটির বেশি টাকা ব্যয় হয়। তবে এর অভ্যন্তরে যে সম্পদ রয়েছে, তার অর্থ মূল্য অনেক বেশি। ভল্টের প্রতিটি বাক্সে রয়েছে ভবিষ্যতের খাদ্যসুরক্ষার চাবিকাঠি। সে কারণে অনেকেই এর নাম রেখেছেন ‘ডুমসডে ভল্ট’।
মানবজাতির স্বার্থে এই ভল্টে চিরবৈরি ভারত-পাকিস্তান, আমেরিকা-মেক্সিকো, চীন-জাপান, উত্তর-দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের নানা দেশের শস্যবীজের নমুনা হিমায়িত মিলেমিশে রয়েছে। এমন কি সামরিক ক্ষেত্রে রাশিয়া ও ইউক্রেন ফাঁরাক থাকলেও দুই দেশ থেকে আসা হিমায়িত বীজও একে অপরের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
বরফে ঢাকা স্বালবার্ডের আয়তাকার ভল্টের দরজা সাধারণ মানুষের জন্য সব সময়ই বন্ধ থাকে। তবে ১৫তম বর্ষপূর্তিতে উৎসাহীদের জন্য প্রবেশের ব্যবস্থা করেছিল নরওয়ে সরকার। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে নজরে পড়ে একটি সংক্ষিপ্ত সুড়ঙ্গ। যেখানে পা রাখলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রের বৈদ্যুতিক আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। পুরো সুড়ঙ্গ পথটি অসংখ্য আলোয় জ্বলজ্বল করে।
কংক্রিটের সেই সুড়ঙ্গপথ ধরে ৪৩০ ফুট গভীরে যাওয়া যায়। সুড়ঙ্গের শেষে গিয়ে কয়েকটি দরজা দেখা যায়। তার মধ্যে একটি দরজা খুলে পৌঁছে যাওয়া যায় মূল চেম্বারে। সেই চেম্বারে তিনটি ভল্ট রয়েছে। তার মাঝের ভল্টটিতে হিমায়িত বীজগুলো রাখা রয়েছে।
শস্যদানা সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সদৃশ রেখে ভল্টের ভেতরের তাপমাত্রা মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখা হয়। সেখানে মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত অজস্র তাকে রয়েছে অসংখ্য রুপার প্যাকেট, যার প্রতিটিই বায়ুনিরোধক।
বিশ্বজুড়ে এ ধরনের ১,৭০০ জিনব্যাংক বা ভল্ট রয়েছে। নতুন ধরনের বীজ তৈরির কাজ, সংরক্ষণে ও গবেষণার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে বীজের আদান-প্রদানও হয়। নরওয়ের এই ভল্টটিকে ঘিরে বিশ্ববাসীর বহু আগ্রহ রয়েছে। কারণ এই ভল্টের ভেতরে ১৩ হাজার বছরের কৃষিকাজের ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে। এছাড়া বিশ্বের নানা প্রান্তে ভৌগোলিক-রাজনৈতিক উত্তেজনার আবহ থাকলেও ‘ডুমসডে ভল্টে’ তার চিহ্নমাত্র নেই।